বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ-Existentialism in Bangla Literature
বিশ্ব সাহিত্যে এক এক সময় এক এক ধরনের ইজমের প্রভাব এসেছে। কখনো সুররিয়ালিজম, কখনো মিস্টিসিজম, কখনো সিম্বলিজম, কখনো এক্সপ্রেশানিজম, কখনো মডার্নিজম, কখনো ফিউচারিজমসহ প্রায় শতাধিক ইজম আবর্তিত হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে মানুষের বোধ পরিবর্তিত হয়ে পরিপক্বতার দিকে এগিয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ইজমের প্রভাব ব্যাপক হয়ে ওঠে। এ রকম একটি ইজম একজিসটেন্সিয়ালিজম বা অস্তিত্ববাদ। মানব হৃদয়ের ক্ষরণে জর্জরিত আত্মা এক সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে এবং শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। কখনো প্রতিবাদী, কখনো সংগ্রামমুখর হয়ে ওঠে। বেঁচে থাকাটাই চরম সত্য, এ বোধ কার্যকরী হয়, একনিষ্ঠ হয়। এ বোধ থেকেই অস্তিত্ববাদের সোনালি যাত্রা শুরু।
অস্তিত্ববাদী দর্শনের বীজ রোপিত হয় জার্মান দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্দ, হাইডেগার, নিটশে প্রমুখের হাতে। তাদের দর্শনে যান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ জীবন-জগতের পটভূমিকায় মানুষের মূল্য ও অবস্থান স্পষ্ট হয়। আকস্মিক ও নিরর্থক (অনংঁৎফ) জীবন ব্যক্তি মানুষ তার অস্তিত্বের কারণেই মূল্যবান; অর্থহীন পারিপার্শ্বিক অবস্থানের মধ্যে সে আরোপ করে তার আপন চেতনাসম্ভূত অর্থ তার কর্মের মাধ্যমে এবং জীবনকে এভাবেই সে অর্থপূর্ণ করে তোলে; এই হলো অস্তিত্ববাদী দর্শনের মূল কথা। উনিশ শতকের সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ বিভিন্নভাবে উঠে আসে রুশ কথাসাহিত্যিক ডস্টয়ভস্কি, চেক লেখক ফ্রানৎস কাফকার গল্প ও উপন্যাসে। অস্তিত্ববাদকে সাহিত্যের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলেন ফরাসি দার্শনিক-সাহিত্যিক জ্যাঁপল সাত্রে ও সিমন দ্য বোভেয়ার। আলবেয়ার কাম্যু, আঁদ্রে মালরো এই ধারার বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক।
‘চেতনা প্রবাহ রীতি’র (Stream of consciousness)
‘চেতনা প্রবাহ রীতি’র (Stream of consciousness) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে সিগম্রু ফ্রয়েড কথিত মনস্তত্বের ‘অবাধ অনুষঙ্গ’ (Free association) এর। এই রীতিতে চরিত্র ও ঘটনা পরষ্পর বাহ্যিক কার্যকারণ সূত্রে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয় না। চরিত্রের চেতনা বা চিন্তার মধ্য দিয়ে আপাত-অসংলগ্ন বা বিশৃঙ্খলভাবে এতে ঘটনাসমূহ গ্রথিত হয়। কথা সাহিত্যের সমালোচনা প্রসঙ্গে ‘ঝঃৎবধস ড়ভ পড়হংপরড়ঁংহবংং’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন মি. মে সিনক্লেয়ার ১৯১৮ খৃ. প্রকাশিত ডরোথি রিচার্ডসনের একটি উপন্যাস আলোচনায়। মনোবিশেষণের ক্ষেত্রে এর আগে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকেই ফ্রয়েড এবং ইয়ুং ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু উপন্যাসের চরিত্রের মনোচিত্রনে প্রয়োগ ঘটান ভার্জিনিয়া উলফ, জেমস জয়েস এবং ডরোথি রিচার্ডসন। আধুনিক ইংরেজি ঔপন্যাসিকের মধ্যে যারা চরিত্রের মনোবিশেষণে চেতনা প্রবাহ রীতির প্রকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তারা হলেন মে সিনক্লেয়ার, শেরউড এন্ডারসন, ইউন্ডারহাম লুই প্রমুখ।
মানুষের জীবনের তিন-চতুর্থাংশই অবচেতন। আধুনিক যুগে বিভিন্ন মনস্তত্ত্ববিদ ও দার্শনিকরা চেতনা ও অবচেতনার প্রতি অধিক মনোযোগী। কারণ যে এক-চতুর্থাংশ সচেতন সেখানেও অলক্ষ্যে অবচেতন কাজ করে। মানব মন সর্বদাই চেতনা ও অবচেতনার দ্বারা আলোড়িত। মানব মন অখণ্ডিত পানি প্রবাহের মতো, এ জন্য মনের ঘটনাবলি বা চিন্তারাজি সুগ্রথিত ও সুসম্পাদিত নয়, তা প্রায়শই অপ্রাসঙ্গিক ও পরস্পর সম্পর্কবিহীন। মানুষের মন যে কখন কী বিষয়ে ভাববে তা ব্যক্তির সচেতন প্রয়াস নিরপেক্ষ মনে অনেক ক্ষেত্রেই স্থিরিকৃত হয় না। কোনো এক বিষয়ে ভাবতে গিয়ে মন কখন যে সম্পূর্ণ বিপরীত বিষয়ে ভাবতে থাকে তা ব্যক্তি টেরও পায় না। সে জন্য শিল্পী-কথাশিল্পী কারো মনের নিঁখুত চিত্রাঙ্কন করতে চেষ্টা করেন, তাহলে তা এলোমেলো হতে বাধ্য; যা আমরা জমেস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, রিচার্ডসনের উপন্যাসগুলোতে লক্ষ্য করি।
চেতনা প্রবাহ রীতি
‘চেতনা প্রবাহ রীতি’তে লিখিত উপন্যাসের ভেতর অন্যতম জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এবং ‘ফিনেগানস ওয়েক’। ‘ইউলিসিস’ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘The stream of consciousness that is here ( in ulysses) transcribed is a very muddy stream, through out the whole book the same kind of transcription goes on broken words, broken phrases, jamboree of senseless syllables here and a race of long sounding words there, the latter having meaning in them selves but no meaning when strung together…’ জেমস জয়েসের পাশাপাশি ভার্জিনিয়া উলফের অবদানও স্বীকৃত। মনোস্রোতের ব্যাখ্যা তিনিও বেশ ভালোভাবেই দিয়েছেন। ‘বায়ুর চাপ যেমন সকলের ওপর প্রভাব ফেলে, তেমনই বহিঃপৃথিবীর ঘটনাবলি মনের ওপরও সুদীর্ঘভাবে বিম্বিত হয়; দক্ষ শিল্পী যেটুকু সম্ভবপর এবং প্রয়োজন, সে টুকু তার তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন।’
আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে একজিসটেন্সিয়ালিজম বা অস্তিত্ববাদের প্রভাব
আধুনিক শিল্প-সাহিত্যে একজিসটেন্সিয়ালিজম বা অস্তিত্ববাদের প্রভাব ব্যাপক। অস্তিত্ববাদের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে জ্যা পল সাঁর্ত্রের। ঐতিহ্য ও ঐতিহ্যবিরোধিতার এক আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছে সাঁত্রের সাহিত্য ও শিল্পকর্মে। পাশাপাশি সত্যানুসন্ধানে দ্য কার্তের স্বচ্ছ চিন্তা ও যুক্তি ফরাসি মনন-মানসে গভীর অনুরণন সৃষ্টি করে। মানুষের আত্মার ভেতর স্বাধীনতা, স্বকীয়তা ও অস্তিত্বকে বাধা দিচ্ছে অন্তরের ভয়াবহ অন্ধকার ও যন্ত্রণার অগ্নিগহŸর। প্রতি মুহূর্তে এ যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে অস্তিত্বের আঁশ আর আঘাতে আঘাতে প্রচণ্ড ব্যথায় হৃদয় হচ্ছে রক্তাক্ত, ক্ষত, পর্যুদস্ত। অবিরত যন্ত্রণার অগ্নি গহŸরের উন্মত্ত শিখা শিল্পী চিত্তকে করছে দগ্ধ, প্রজ¦লিত। মানুষের রয়েছে চিন্তার স্বাধীনতা; অথচ জীবন জিজ্ঞাসা ও সত্যকে উন্মোচনের পথে দাঁড়িয়ে আছে অস্থির আতঙ্ক এবং ভয়ঙ্কর অনস্তিত্ব ও অনিশ্চয়তা। মানুষের আত্মা বিদীর্ণ হচ্ছে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে অবিরত। ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বিদীর্ণ আত্মা। যুক্তির মুক্তি মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। তবুও মানুষ শত বাধা সত্ত্বেও অখণ্ড জলের মতো অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে। অস্তিত্ববাদী লেখা যারা লিখেছেন, তাদের ভেতর রয়েছে জ্যাঁ রাসেন, বোদলেয়ার, র্যাবো, মরিয়ক, মার্লোসহ অনেকেই। এ সকল কবি ও লেখকদের অগ্রজ পথিকৃৎ বলা যায় লেখক ও দার্শনিক জ্যাঁ পল সাঁত্রকে। ‘সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’। এক বিশেষ বোধ মানুষের মানব চৈতন্যকে পরিশীলিত করে, উজ্জীবিত করে, শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দেয়। উইলিয়াম জেমস বলেছেন, ‘Consciousness does not appear to it self chopped up in bits…It is nothing jointed; it flows.., Let us call it the stream of thought, of consciousness, or of subjective life’.
বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ
মানুষের চিন্তা ও চেতনা সর্বদা নতুনত্বকে কাছে পেতে চায়। নতুনত্বের ভেতরে আত্মা এক ধরনের শিহরণ অনুভব করে। এ জন্য শত বাধা, ভয়ঙ্কর অন্ধকার, জ্বালা-যন্ত্রণা ও হৃদয়ে প্রজ¦লিত অগ্নিকুণ্ডের পথকে প্রশস্ত করে সে এগিয়ে চলে মৌলিক চিন্তা ও সৃষ্টির প্রকর্ষণায়। দৃঢ় প্রত্যয়ী অস্তিত্ববাদী সাঁত্রে বলেছেন, ‘এসব দেখেই থেমে যেতে হবে কেন? বাঁচতে হবে, টিকে থাকতে হবে, আঘাতে আঘাতে জেগে উঠবে জীবন, অরুনিমার আভা নিয়ে জীবনের আলো ফুটে উঠবে, জীবনের মহিমা ভাস্মর হবে, অন্ধকার দূর হয়ে নব প্রাণের হবে অভ্যুদয়। ভয়াবহ অন্ধকার ও যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডেই ফুল ফুটিয়ে দেখাতে হবে যে, আমি বেঁচে আছি, আমি অস্তিত্ববান। জীবন এবং যাত্রা পথ দুর্বোধ্য ও জটিল বলেই কি হাল ছেড়ে দিতে হবে? আমাদের কি হতে হবে দৃষ্টিহীন? তাই পথ যতই বাঁকা ও আঁধার হোক না কেন, সামনে যতই মৃত্যু মাতাল অগ্নি সমুদ্র থাক না কেন-অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য সামনে চলতে হবে, নতুন পথ সৃষ্টি করতে হবে, কারণ মানুষ অস্তিত্ববান ও সৃজনশীল।’ দ্য কার্তের অস্তিত্ববাদী উচ্চারণ কিছুটা স্বতন্ত্র। তিনি বলেছেন, ‘আমি চিন্তা করি, অতএব আমি আছি অর্থাৎ আমার অস্তিত্বশীলতাই আমার অস্তিত্বের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং আমার অস্তিত্বকে প্রমাণ করছে।’ জ্যাঁ পল সাঁত্র আরো পরিষ্কারভাবে তার মতকে প্রকটিত করেছেন, ‘আমার অস্তিত্ব আছে বলেই আমি চিন্তা করি।’ এ ক্ষেত্রে অস্তিত্বকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অস্তিত্ব থেকে চিন্তার উদ্ভব ঘটে। প্যাসক্যাল বলেছেন, ‘মানুষ দুনিয়া জয়ের পরিবর্তে নিজেকেই জয় করে, দুনিয়া জয় করা কথাটা আসলে ভুল মাত্র- এ জয় তার ভেতরেই ছিল, এখন তা শুধু বাইরে প্রকাশিত হয়েছে।’ দৃঢ় প্রত্যয় ও অস্তিত্বের উজ্জ্বলতায় ভাস্বর সাঁর্ত্রে বলেছেন, ‘মানুষ হচ্ছে তার কর্মের সমাহার। আজ সে যতটুকু করছে, তা সে শুধু তার নিজেকেই প্রকাশ করেছে মাত্র।’ দার্শনিক আঁদ্রে জিদ বলেছেন, ‘প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র এবং অন্তঃ সমস্যাও ভিন্ন ভিন্ন। উপদেশ কোনো সমস্যার সমাধান করে না এবং তা কোনো উপকারেও আসে না। বরং উপদেশের খপ্পরে পড়ে মানুষ তার স্বকীয়তা ও অস্তিত্বকে হারায়। উপদেশের প্রলেপে আবৃত হয়ে আসল মানুষ স্বাভাবিকভাবে যা হতে পারত উপদেশের চোটে সে আর তা হতে পারে না।’ সাঁত্রে বলেছেন, ‘অন্যের কাছ থেকে পাওয়া দর্জিছাটা নীতি দিয়ে জীবনকে চালিত করতে গেলে স্বকীয়তা ও জীবনকে হারাতে হয়।’ সাঁত্রে ঈশ্বরভক্ত নন। বিশ্বাসীদের তিনি বন্দি বলেছেন। তাদের দেখেছেন কৃপা ও করুণার দৃষ্টিতে। নিয়ম বন্ধনহীন মানুষকে তিনি মনে করেন স্বাধীন, স্বাভাবিক ও অস্তিত্ববান। তার এ মতাদর্শ তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন, শিল্পরূপ দিয়েছেন নাটক, উপন্যাস ও প্রবন্ধে। তার লেখা চরিত্রগুলো একই সাথে অস্তিত্বের যন্ত্রণায় কাতর আবার অস্তিত্বের প্রতি আস্থাশীল। অস্তিত্ব ও চিন্তার স্বাধীনতা তার সাহিত্যের প্রধান বিষয়। সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদে অনুরাগী সাঁত্রে মানুষের স্ব-ইচ্ছা ও স্বকীয়তায় বিশ্বাসী। ক্যামু বলেছেন, ‘মানুষ যদি থাকে সমাজের বাইরে সে হবে আউট সাইডার।’ দার্শনিক কিয়ের্কে গার্ড এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছেন যে, ‘অস্তিত্ব মানুষের নাস্তিকতাকেই প্রকাশ করে। কাউকে নীতি বা নিয়মের বলয়ে রাখতে গেলে সে তার স্বকীয়তা হারায়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমি গণিতের প্রতীক নই-আমি অস্তিত্ববান, আমি সৎ। ’
অস্তিত্ববাদ
অস্তিত্ববাদ একটি দার্শনিক প্রতিপাদ্য। এ মতবাদের মৌল উপজীব্য ব্যক্তির সর্বৈব অস্তিত্ব। ডেকার্ট বলেছিলেন, ‘আমি চিন্তা করি সুতরাং আমি আছি .’ অস্তিত্ববাদের মর্মমূলে রয়েছে ডেকার্টের দর্শন। মানুষের রয়েছে স্বাধীন চিন্তা শক্তি এবং তার সাথে যুক্ত দায়িত্ববোধ। তাই অস্তিত্ববাদ জোর দেয় মানুষের কর্মের ওপর। অস্তিত্ববাদীর বিবেচনায় জীবন অবিরাম গতিশীল, নিরন্তর প্রবহমান। মানব জীবন এক ধারাবাহিকতা। মানুষের জীবন, তার সকল সম্ভাবনা ও বিকাশ, সব ফুল ফোটাবার দায়িত্ব সবই তার। অস্তিত্ববাদে মানুষ স্বাধীন, সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার রয়েছে স্বাধীনতা, ফলে এর সাথে জড়িয়ে আছে অবিরাম উৎকণ্ঠা। তার জীবন, কর্ম, স্বাধীনতা ও দায়বোধ একান্তভাবে তার নিজেরই। ফলে হতাশা, ব্যর্থতা, মৃত্যু, আত্মহত্যা অস্তিত্ববাদের সাথে জড়িত। অস্তিত্ববাদের বৈশিষ্ট্য এর ভেতর রয়েছে :
** ‘মানুষের রয়েছে চিন্তা ও ইচ্ছার স্বাধীনতা। মানুষের পরিণতি পূর্বনির্ধারিত নয়। অপূর্ণ মানুষ তার স্বাধীন কর্ম দিয়ে নিজেকে পূর্ণ করার সর্বৈব স্বাধীনতা ভোগ করে।
** প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র। প্রত্যেকের সমস্যা স্বতন্ত্র ও সমাধান নিজস্ব পথে সম্পন্ন হয়।
** অস্তিত্ববাদ কর্মের দর্শন। মানুষ নিজেকে বিকশিত ও নির্মাণ করে তার নিজস্ব চিন্তা ও কর্ম দিয়ে।
** যেহেতু মানুষ চিন্তা ও কর্মে স্বাধীন, ফলে সে দায়বোধ সম্পন্ন।
** নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে সে পারিপার্শ্বিক তথা বিশ্বমানবের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে আবদ্ধ হওয়ায় হয়ে ওঠে মানবতাবাদী।
** মানুষের স্বাধীন ও দায়িত্বসম্পন্ন সত্তা সৎ, শুভ ও বিশ্বমানবের মঙ্গল সাধনে বদ্ধপরিকর।’
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে অস্তিত্ববাদ
বাংলা সাহিত্যে অস্তিত্ববাদকে গ্রথিত করেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তার ছোট গল্প ‘মৃত্যুযাত্রী’, ‘খুনী’, ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতা’, ‘গ্রীষ্মের ছুটি’, ‘হোমেরা’, ‘স্বাগত’, ‘স্বপ্নের অধ্যায়’, ‘মৃত্যু’, ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, ‘জাহাজী’, ‘রক্ত’, ‘স্তন’, ‘দ্বীপ’, ‘না কান্দে বুবু’সহ বহু ছোট গল্পে এবং উপন্যাস ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’তে অস্তিত্ববাদকে ফুটিয়ে তুলেছেন জীবন্তভাবে। মানব হৃদয়ের অতলান্ত দ্ব›দ্ব, জীবন জিজ্ঞাসা-জটিলতা, আলো-আঁধারীর খেলা, নৈর্ব্যক্তিক জীবন বোধ, ছায়া ও মায়া তার লেখাগুলোকে করেছে প্রাঞ্জল ও ভাবালুতায় আবিষ্ট। প্রতিটি ক্ষেত্রে অস্তিত্ববাদ প্রখর হয়ে ওঠে। ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় যুবক শিক্ষকের অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব বারংবার দোলায়িত হয়েছে মরীচিকার মতো। অথচ শেষে সব বাধা অতিক্রম করে সে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে। মৃত্যুভীতি দূর হয়ে যায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আত্মজিজ্ঞাসা থেকে জানা যায়, ‘The central theme is the knowledge of a crime-the evil act-of which the young teacher becomes the possessor and which frightens him because of the responsibility attached with it; the evil act, as it were, passes on to the teacher as well. What I want to say is that the most important thing is not so much an evil act, nor its perpetrator but the attitude of the man out side such an act, from a coward the young teacher rises to a brave man and a martyr as well.’
অস্তিত্ববাদী চেতনা শিল্পী মানসকে আলোড়িত করে উদ্বেলিত করেছে। ধ্বংস, মৃত্যুর ভয়াবহতা, যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ড থেকে আত্মা বেরিয়ে এসে নবতর চেতনায় বিকশিত হয়ে অস্তিত্ববান হয়েছে। অস্তিত্ববাদ সাধারণ মানুষের ভেতর এক অদম্য স্পৃহা জাগিয়েছে। এক ব্যক্তি হৃদয় থেকে সমষ্টি হৃদয়ে আচ্ছাদিত হয়েছে। ব্যক্তির বিদ্রোহ হয়ে উঠেছে গণবিপ্লব ও জনতার মুক্তির সংগ্রাম। সে সংগ্রামে বহু শিল্পী ও সাহিত্যিক নিজেদের একীভূত করেছেন, সত্য উন্মোচনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন; তবু অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। সত্য প্রকাশের জন্য সাঁত্রে সংগ্রাম করেছেন, হরিয়েছেন চাকরি, জীবনকে টিকিয়ে রাখবার জন্য পথে পথে পত্রিকা বিক্রি করেছেন, তবু আপস করেননি। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিক শক্তি নিয়ন্ত্রিত নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিরন্নক্লিষ্ট মানুষের জন্য যে সাহিত্য নয়, তাকে তিনি প্রকৃত সাহিত্য বলে স্বীকার করেননি। মানুষের আত্মার মুক্তির জন্য, চিন্তার স্বাধীনতাকে উজ্জীবিত করার জন্য পর্যায়ক্রমে বহু কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী তাদের সাহিত্য ও শিল্পকর্মে অস্তিত্ববাদকে প্রখরভাবে প্রকটিত করে তুলেছেন।