বাংলা কবিতার উদ্ভব ও বিকাশ

                       বাংলা কবিতার উদ্ভব ও বিকাশ : একটি রূপরেখা


নানা বিতর্ক ও ভিন্নমত থাকলেও, একথা আজ সকলেই মেনে নিয়েছেন যে বাংলা সাহিত্যের বয়স আনুমানিক এক হাজার বছর। পৃথিবীর সব সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেরও যাত্রা শুরু কবিতা দিয়ে। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। আনুমানিক এক হাজার বছর পূর্বে এগুলো রচিত হয়েছে বলে পন্ডিতেরা মনে করেন। বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকদের রচিত এ পদগুলো দীর্ঘদিন অনাবিষ্কৃত ছিল। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এগুলো নেপাল রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে উদ্ধার করেন। চর্যাপদে প্রাচীন বাংলার সমাজ জীবনের নানা ছবি চিত্রিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মের তত্ত¡কথা অবলম্বনে রচিত হলেও, চর্যাপদগুলো সাহিত্যগুণেও অনন্য। চর্যাপদের প্রধান কবিরা হলেন লুইপাদ, ভুসুকুপাদ, কাহ্নপাদ, সরহপাদ, শান্তিপাদ ও শরপাদ। চর্যাপদ ছাড়া প্রাচীন যুগের (৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগ বলা হয়) আর কোন সাহিত্য নিদর্শন এ যাবৎ আবিষ্কৃত হয়নি।

চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্যের উল্লেখ্য যোগ্য  সাহিত্যকর্ম হচ্ছে বড়– চন্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য’। আনুমানিক ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে এ কাব্য রচিত হয়েছে বলে পন্ডিতেরা মত প্রকাশ করেছেন। তবে চর্যাপদের মতোই এ কাব্যও রচনার বহু শতাব্দী পরে আবিষ্কৃত হয়। ১৯০৯ সালে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রাম থেকে কাব্যের পুঁথিটি উদ্ধার করেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বলভ। এটি রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক আখ্যানকাব্য। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের (১২০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্তসময়কে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ বলা হয়) প্রথম  নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আরও পড়ুন ----------

মধ্যযুগের বাংলা কবিতা প্রধানত চারটি শাখায় বিকাশ লাভ করে। এ শাখা চারটি হলো-
  1.  বৈষ্ণব পদাবলী,
  2.  মঙ্গলকাব্য,
  3.  অনুবাদ-কাব্য। 
  4. এবং রোমান্সমূলক প্রণয়-কাব্য 
চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মতো এ-সব সাহিত্যশাখাও ধর্মচিন্তাকে কেন্দ্র করে বিকাশ লাভ করে। 

বৈষ্ণব পদাবলী

বৈষ্ণব ধর্মমতকে অবলম্বন করে রচিত হয় বৈষ্ণব পদাবলী। চৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) মানবতাবাদী ধর্মচিন্তা বৈষ্ণব সাহিত্যসৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ প্রেরণা সঞ্চার করে। সাহিত্যগুণে বৈষ্ণব পদাবলী বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সম্পদ। রাধা-কৃষ্ণের মর্ত্যলীলাকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলী। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রধান কবিরা হচ্ছে ন- বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস ও বলরামদাস।

 মঙ্গলকাব্য

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শাখা হচ্ছে মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্য রচনার পশ্চাতেও ধর্মীয় প্রেরণা কাজ করেছে। খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্তসময়কালে রচিত হয় মঙ্গলকাব্য। বিভিনড়ব দেব-দেবীর ারজা প্রচার সম্পর্কিত এক প্রকার আখ্যানকাব্যকে মঙ্গলকাব্য বলে। মধ্যযুগের মানুষ জাগতিক নানা প্রয়োজনে ও বিপদে-আপদে এ-সব দেব-দেবীর শরণাপনড়ব হয়েছে। এভাবে হিংস্র শ্বাপদের আμমণ থেকে বাঁচার জন্য চন্ডীদেবীর পরিকল্পনা, সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্য মনসাদেবীর অধিষ্ঠান, বসন্তরোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য শীতলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরূপে আরও বহু দেব-দেবীর পরিকল্পনা করা হয়েছে। নানা দেব-দেবীর পরিকল্পনার কারণে মঙ্গলকাব্যেও রয়েছে নানা শাখা। মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, অনড়বদামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, শিবমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, প্রভৃতি হচ্ছে মঙ্গলকাব্যের প্রধান প্রধান শাখা। মনসামঙ্গলের প্রধান কবিরা হচ্ছেন বিজয় গুপ্ত, নারায়ন দেব, বিপ্রদাস প্রমুখ। চন্ডীমঙ্গলের প্রধান কবি হচ্ছেন মুকুন্দরাম চμবর্তী, যিনি কবিকঙ্কন নামে সমধিক পরিচিত। অনড়বদামঙ্গলের প্রধান কবির নাম ভারতচন্দ্র রায়। মঙ্গলকাব্যসমূ হ ধর্মীয় প্রেরণার রচিত হলেও এ-সব কাব্য মধ্যযুগের বাংলাদেশের সমাজ ও
সভ্যতার নানা দিক বিধৃত হয়ে আছে। সাহিত্যগুণেও এ-কাব্য বিশিষ্টতার পরিচয়বাহী।

অনুবাদ-কাব্য

ধর্মীয় প্রেরণায় রচিত মধ্যযুগের সাহিত্যের আর একটি উলে−খযোগ্য শাখা হচ্ছে অনুবাদ কাব্য। সংস্কৃত রামায়ণ মহাভারত ভাগবতের অনুবাদের মাধ্যমে এ কাব্যশাখার সৃষ্টি। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্তঅনুবাদকাব্য বিশেষ বিকাশ লাভ করে। রামায়ণ-মহাভারত ভাগবতের অনুবাদের মাধ্যমে নতুন জীবনাদর্শে সমাজ গড়ার স্বপড়ব দেখেছিলেন অনুবাদকরা। বাল্মীকির মূল রামায়ণ প্রম বাংলায় অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস ওঝা। পঞ্চদশ শতাব্দীতে তিনি রামায়ণ অনুবাদ করেন। মহাভারতের প্রথম বঙ্গানুবাদক হচ্ছেন কাশীরাম দাস। আরও অনেক কবি রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করে বাংলা অনুবাদ কাব্যের শাখাটি সমৃদ্ধ করেছেন।

রোমান্সমূলক প্রণয়-কাব্য 

মধ্যযুগে এ পর্যন্তযে-সব সাহিত্যশাখার কথা আমরা জেনেছি, তার সবগুলোই হিন্দু ধর্মের বিষয় ও বিধানকে অবলম্বন করে রচিত। ইসলাম ধর্মের প্রসার ও প্রচারকল্পে সুফী ধর্মমতের প্রত্যক্ষ প্রেরণায় এ-সময় মুসলিম কবিদের হাতে নতুন এক কাব্যশাখার সৃষ্টি হয়। সাহিত্যের ইতিহাসে এ কাব্যশাখা রোমান্সমূলক প্রণয়-কাব্য  নামে পরিচিত। এগুলো মূলত আখ্যান কাব্য। বাংলা রোমান্সমূলক প্রণয়-কাব্য  ধারায় যাঁদের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়, তাঁরা হচ্ছেন সৈয়দ সুলতান, সৈয়দ আলাওল, মুহম্মদ কবীর, কাজী দৌলত, দৌলত উজির বাহরাম খান প্রমুখ। এঁদের মধ্যে সৈয়দ আলাওলের অবদান খুবই উলে−খযোগ্য। পদ্মাবতী, হপ্তপয়কর প্রভৃতি আলাওলের উলে−খযোগ্য কাব্য। রোমান্সমূলক প্রণয়-কাব্য সমূহ ধর্মীয় প্রেরণায় সৃষ্টি হলেও, এগুলোর মধ্যেও মধ্যযুগের বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সামাজিক পরিচয় পাওয়া যায়।

মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সন্ধিক্ষণে বাংলা কাব্যে আবির্ভূত হন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯)। এজন্য তাঁকে ‘যুগ-সন্ধিক্ষণের’ কবি বলা হয়। তিনি খণ্ড কবিতা রচনা করেন।

১৮০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্তসময়কালকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক যুগে এসে বাংলা সাহিত্য কেবল কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বহু বিচিত্র শাখায় বিচিত্র ভাবে তা বিকাশ লাভ করে। তবে এখানে আমরা কেবল কবিতা সম্পর্কেই জানার চেষ্টা করবো। আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম  কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)

  মাইকেল মধুসূদন দত্তই বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি। তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্রষ্টা হিসেবে সমধিক পরিচিত। তাঁর অমর কীর্তি ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১)। এটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য। তিনি পত্রকাব্য এবং সনেটেরও প্রবর্তক। ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রভৃতি মাইকেল মধুসূদন দত্তের অন্যান্য শ্রেষ্ঠ রচনা।

মধুসূদন যেমন মহাকাব্য, পত্রকাব্য এবং সনেটের প্রবর্তক, বিহারীলাল চμবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪) তেমনি গীতি কবিতার প্রবর্তক। তার ‘সঙ্গীত শতক-ই (১৮৬২) হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রম গীতিকবিতার সঙ্কলন। গীতিকবিতার প্রবর্তন করেছেন বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বিহারীলালের অন্যান্য কাব্যের নাম বঙ্গ-সুন্দরী, নিসর্গ সন্দর্শন, বন্ধু বিয়োগ, সাধের আসন, সারদামঙ্গল ইত্যাদি।

এ পর্বেই বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) উজ্জ্বল আবির্ভাব। রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা কাব্য নতুন নতুন মাত্রায় অভিষিক্ত হলো। দুই শতাব্দী জুড়ে রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনা বিস্তৃত। ১৯৭৬ সালে মাত্র পনের বছর বয়সে তাঁর প্রম কাব্য ‘বনফুল’ প্রকাশিত হয়। তাঁর সর্বশেষ কাব্য ‘শেষলেখা’ প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালে। মাঝখানে রয়েছে পঞ্চাশের অধিক কাব্যগ্রন্থ। এ-সব কাব্যের মধ্যে বিশেষভাবে উলে−খযোগ্য মানসী, সোনারতরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, গীতাঞ্জলি, বলাকা, পুনশ্চ, পত্রার ট, জন্মদিনে প্রভৃতি। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ বিষয় ও প্রকরণে বাংলা কবিতার মান বহুগুণে সমৃদ্ধ করেন। মানবতাবাদী চিন্তায় রবীন্দ্রনাথের শেষপর্বের কবিতা বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ। প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা, নিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন-নতুন ছন্দোরীতি, বিষ্ময়কর সংক্ষিপ্তরূপ, অলঙ্কারের স্বল্পতা এবং ভাবসংগতিতে শেষ পর্বের রবীন্দ্রকবিতা বিশিষ্ট ও উজ্জ্বল।

রবীন্দ্রনাথের সমকালে কবিতা লিখে খ্যাতি অর্জন করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭৭-১৯৫৫), যতীন্দ্রমোহন বাগচী (১৮৭৭-১৯৪৮), কুমুদরঞ্জন মলি−ক (১৮৮৩-১৯৭০), কালিদাস রায় (১৮৮৯-১৯৭৫) প্রমুখ। কিছু স্বাতন্ত্র্য থাকলেও, এঁরা মূলত রবীন্দ্রনাথের কাব্যচিন্তাতেই লালিত-পালিত ও বর্ধিত। তাই এঁদেরকে রবীন্দ্র-বলয়ের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

এ কালের অন্য তিনজন কবি রবীন্দ্রনাথকে অতিμম করে প্রকাশের একটা স্বতন্ত্র পথ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এ কবিত্রয় হচ্ছেন যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত (১৮৮৭-১৯৫৪), মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২) এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩)। কবিতার বিষয় এবং আঙ্গিকে এঁরা রবীন্দ্রনাথের দূরবর্তী জগতের মানুষ।

উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম কবি হিসেবে কায়কোবাদের (১৮৫৭-১৯৫১) অবদানও এখানে স্মরণীয়। ‘মহাশ্মশান’ কাব্য রচনা করে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর অন্যান্য কাব্য হচ্ছে ‘অশ্র“মালা’, ‘অমিয়ধারা’ প্রভৃতি। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চেতনা কায়কোবাদের কবি প্রতিভার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

বিংশ শতাব্দীর বিশ দশকের সর্বাপেক্ষা প্রবল-প্রাণ কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি বিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত। নজরুল ইসলাম মূলত রোমান্টিক কবি। রোমান্টিকতার অন্তর-প্রেরণায় তিনি কখনো উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী, কখনো বা গেয়েছেন প্রেম সৌন্দর্যের গান। শব্দব্যবহার ও অলঙ্কার নির্মাণেও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রধান প্রধান কাব্যের নাম অগিড়ববীণা, সাম্যবাদী, ভাঙার গান, দোলন চাঁপা, পুবের হাওয়া, চμবাক, সিন্ধু-হিন্দোল, মরুভাস্কর ইত্যাদি।

এ পর্বের একজন উলে−খযোগ্য কবি জসীমউদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬)। পল−ী বাংলার জীবন ও বিশ্বাসকে অবলম্বন করে বাংলা কবিতায় তিনি সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারা নির্মাণ করেছেন। রাখালী, নক্শী কাাঁর মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট প্রভৃতি জসীমউদ্দীনের উলে−খযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।

বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে এসে বাংলা কবিতায় নতুন পরিবর্তন সূচিত হলো। জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), অমিয় চμবর্তী (১৯০১-১৯৯৩), অজিত দত্ত (১৯০৭-১৯৭৯), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২) প্রমুখ এ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি। এঁরা তিরিশোত্তর কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। এঁদের কবিতার প্রধান প্রবণতা আধুনিক জীবনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবিশ্বাস রূপায়ণ ও রবীন্দ্র-বিরোধিতা। তিরিশোত্তর এ কবি সমাজের হাতে বাংলা কবিতা বিষয় ও আঙ্গিকে নতুন মাত্রা অর্জন করে।

চল্লিশের  দশকে বাংলা কবিতায় সমাজমনস্কতার ছায়াপাত ঘটে। পুঁজিবাদ বিরোধিতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তার প্রকাশ এ-পর্বের কবিতার প্রধান লক্ষণ। এ দশকের প্রধান কবিরা হলেন, সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুকান্তভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, দিনেশ দাশ, কিরুণশঙ্কর সেনগুপ্ত, মঙ্গলাচরণ চট্টেপাধ্যাায় প্রমুখ।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির ফলে বাংলা কবিতা দুটি ভিনড়ব খাতে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্ব বাংলা কেন্দ্রিক কবিরা বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণে সচেষ্ট হলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এ ধারার কবিদের মধ্যে প্রবল প্রতিবাদী চেতনা সৃষ্টি করে। এ ধারার কবিদের মধ্যে বিশেষভাবে উলে−যোগ্যা হলেন আবুল হোসেন, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গণি হাজারী, সানাউল হক, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল-আজাদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান প্রমুখ। ষাটের দশকের পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্তআরও অনেক কবি পূর্ববালা তথা বাংলাদেশ কেন্দ্রিক কাব্যধারা বিকাশে গুরুত্বার র্ণ ভ‚মিকা পালন করেছেন।

১৯৪৭ পরবর্তীকালে পশ্চিমবাংলার কবিতাও স্বতন্ত্র পথে বিকাশ লাভ করে। এ-পর্বে পশ্চিমবাংলার প্রধান কবিরা হচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চμবর্তী, সিদ্ধেশ্বর সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ। অনেক নবীন কবি সম্মিলিত সাধনায় পশ্চিম বাংলার কবিতা বিকাশে এখন গুরুত্বারপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছেন।

হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাস আমরা সংক্ষেপে ওপরের আলোচনায় তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। এ আলোচনা পাঠ করে আপনি কবিতা অধ্যয়ন করার চেষ্টা করুন, তাহলে পাঠ অনুধাবন আপনার জন্য সহজ হবে।