তিস্তা নদী সংকটের আদ্যোপান্ত
------------------------------------------------------------------------
তিস্তা নদী, বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী।এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের প্রধান নদী। একে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনপ্রবাহ ও বলা হয়। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে ।
তিস্তা চুক্তির ইতিকথাঃ
১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর জল বন্টনের ব্যাপারে স্থির হয় যে, তিস্তা নদীর জলের শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকী ২৫ শতাংশ জল নদীটির সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কী ভাবে এই জল ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে কোন দিকনির্দেশনা ছিল না। বহুকাল পরে ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথবৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার জলের ৮০ শতাংশ দু’দেশের সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করে।
ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত প্রস্তুতিসহ যৌথ নদী কমিশনের তৎপর ভূমিকায় চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি সবাই শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার মনে করেছিল। শেষ পর্যন্ত তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হল না।
নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। ওই সময় মোদি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিও সম্পাদন করতে। কিন্তু সেই চুক্তি সম্পাদনে তীব্র বাধা দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতার কথা ছিল, উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি করতে রাজি নন। এ কারণে মমতার বাধায় আর চুক্তি সম্পাদন করা যায়নি।
২ বছর আগে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাশে রেখেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই সরকারের মেয়াদকালে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নিজের মেয়াদকালে সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারলেন না তিনি।
তিস্তায় পানি সংকটের মুল কারণঃ
নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারত জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে .গজলডোবা বাঁধ স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে। গজলডোবা বাঁধের (ব্যারাজ) মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেছে। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাধ নির্মাণ করে। এই বাঁধে ফটক রয়েছে ৫৪টি যা বন্ধ করে তিস্তার মূল প্রবাহ থেকে পানি বিভিন্ন খাতে পুনর্বাহিত করা হয়। প্রধানত তিস্তার পানি তিস্তা-মহানন্দা খালে পুনার্বাহিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বাঁধ স্থাপন করা হয়। গজলডোবা বাঁধের আগে তিস্তা অববাহিকায় যেখানে ২৫০০ কিউসেক পানি পাওয়া যেত, সেখানে ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে এখন পানি প্রবাহের পরিমাণ ৪০০ কিউসেকেরও কম। ১৯৯৭ সালে বাংলদেশে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির প্রবাহ ছিল প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কিউসেক, যা ২০০৬ সালে নেমে আসে ১ হাজার ৩৪৮ কিউসেকে এবং ২০১৪ সালে পানির প্রবাহ এসে দাঁড়ায় মাত্র ৭০০ কিউসেক, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিস্তা সংকটের ফলে পরিবেশগত ক্ষতি (৩৫ বিসিএস)ঃ
১। ১৯৯৩-৯৪ শস্যবছর থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলায় ব্যাপকভাবে আউশ ও আমন উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকায় নদীর পানি ছাড়া অন্য কোনো সেচের ব্যবস্থা নেই, তাই প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ জমি চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। ফলে ওই অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষক প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে তাঁদের জীবনমানে।
২। পানির দুষ্প্রাপ্যতার কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও আরেক ধরেনের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা, যা সচরাচর বলা হয় না, আর হলেও যে ব্যাপকতায় বলা দরকার, সেভাবে বলা হচ্ছে না, আর তা হচ্ছে পরিবেশগত ক্ষতি। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে। তিস্তা ব্যারাজ এলাকার পর শুকনো মৌসুমে এভাবেই নদী মারা যাচ্ছে।
৩। তিস্তা নদী যখন শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে, তখন যমুনা নদীতেও পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে তিস্তা নদীর যে প্রাকৃতিক কার্যাবলি আছে, শুকনো মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তা বিঘ্নিত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে নদী অববাহিকায় প্রতিবেশগত ভারসাম্য এবং সর্বোপরি তিস্তা হারাচ্ছে তার অতীত পরিবেশগত সক্ষমতা।
৪। তিস্তা নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন নদীকেন্দ্রিক জীববৈচিত্র্যও প্রবল হুমকির সম্মুখীন হয়। এই তিস্তা নদীতে একসময় ইলিশ মাছ পর্যন্ত অহরহ পাওয়া যেত, কিন্তু এখন ইলিশ মাছ তো নয়ই, অন্য প্রজাতির বড় মাছও দুর্লভ হয়ে গেছে।
৫। অপর দিকে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়া এবং নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। এর দরুন উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য এলাকার কৃষক, যাঁরা সরাসরি তিস্তার পানি পান না এবং সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করেন, তাঁদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
৬। তিস্তা নদী যদি এভাবে প্রায় প্রতিবছরই পানির অভাবে শুকিয়ে যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জলবায়ুও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই পরিবেশগত কারণেও তিস্তা নদীর অসীম মূল্য রয়েছে, যা নিয়ে আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণার প্রয়োজন। তিস্তা অববাহিকায় শুষ্ক মৌসুমে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় নদীতে সব সময় ৫৫০ থেকে ৭০০ কিউসেক এবং বোরোর চাহিদা পূরণে আমাদের অন্তত চার হাজার কিউসেক পানি দরকার।
নদী সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনঃ
বস্তুতঃ আন্তর্জাতিক নদীর পানির ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে সম্পাদিত হেলসিংকি নিয়মাবলীতে বিবাদমান রাষ্ট্রগুলোর জন্যে দ্বি-পাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক – এই দুই স্তরেই আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার এবং তার সমবন্টন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানের আইনী পথ বাতলে দেয়া হয়েছে। ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নিয়মাবলী অনুযায়ী ইচ্ছা করলেই উজানের দেশ, এ ধরণের নদীর উপর ভাটির দেশের জন্য ক্ষতিকর এরকম কোন কিছু নির্মাণ করতে পারেনা।
হেলসিংকি নিয়মাবলীর অনুচ্ছেদ ৩০-৩৫ পর্যন্ত, ধাপে ধাপে সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা দেওয়া আছে। যেমনঃ অনুচ্ছেদ ৩০ এ বিবদমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কথা বলা হয়েছে। সেটা সম্ভব না হলে যৌথ প্রতিষ্ঠান তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ নদী কমিশন বর্তমানে সক্রিয় আছে। এর মাধ্যমে সমাধানের সম্ভব না হলে অনুচ্ছেদ ৩২ অনুযায়ী তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধানের পথও খোলা রাখা হয়েছে। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় কোন সমাধান না হলে অনুচ্ছেদ ৩৩ একটি অনুসন্ধান কমিশন গঠণের কথা বলেছে। অনুচ্ছেদ ৩৪ এ আন্তর্জাতিক বিচারালয়সহ অন্যান্য অনেক উপায়ে আন্তর্জাতিক সালিশীর সুযোগও তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে হেলসিংকি নিয়মাবলীর ৩৫নং অনুচ্ছেদে আন্তর্জাতিক সালিশীর জন্য আন্তর্জাতিক আইন কমিশনে শরণাপন্ন হওয়ার বিষয়টিকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে.
শুধুমাত্র তিস্তার পানি চুক্তির সম্ভাব্যতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন দেশের সাধারণ মানুষ। যদিও ভারতের পক্ষ থেকে কয়েক দশক ধরেই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টী ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরে তিস্তার পানি চুক্তির যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সেখানে অতীতের গঙ্গা চুক্তির অভিজ্ঞতার আলোকে আগামীর পথ ও পন্থা নির্ণীত হবে বলে আমরা আশা করছি।পরিশেষে যেটা বলতে চাইছি তা হলো, আমাদের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি প্রশমনের জন্য অবিলম্বে স্বচ্ছতা ও সমতার ভিত্তিতে তিস্তার পানি চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। তিস্তা চুক্তি যতই প্রলম্বিত হবে, আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়বে এবং বাংলাদেশের ক্ষতির বিপরীতে ভারতই লাভবান হতে থাকবে।
//কোন সাজেশান বা তথ্যগত ভুল থাকলে কমেন্টে জানাবেন ।
সুত্রঃ ১। বিভিন্ন দেশীয় গনমাধ্যম ,উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহিত , সম্পাদিত একটি লেখা ।
মুহাম্মদ ইরফান উদ্দীন
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা(সুপারিশপ্রাপ্ত)
0 Comments