বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্যসম্পদের ভূমিকা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্যসম্পদের ভূমিকা

খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুসারে, অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয়। এছাড়া একই উৎস থেকে মৎস্য আহরণে তৃতীয় ও চাষের মাছ উৎপাদনে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। গত এক দশকে মাছ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে পাঁচ অর্থবছরের ব্যবধানে উৎপাদন বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার টন। দেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোয় ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ প্রজনন মৌসুমে মাছ আহরণে নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলার প্রবণতা বৃদ্ধি। এরপর রয়েছে প্লাবনভূমি, পুকুর ও ছোট জলাশয়ে মাছ চাষের ক্ষেত্রে অগ্রগতি। মৎস্যজীবী ও সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা এখানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। রয়েছে মৎস্য বিজ্ঞানীদের অবদানও। তারা বিভিন্ন প্রজাতির দেশী মাছের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন, যেগুলো চাষীরা পুকুর ও ছোট জলাশয়ে পরিকল্পিতভাবে এবং বাণিজ্যিক লক্ষ্যে উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। বাংলাদেশের এমন অর্জনের মধ্যেই উদযাপন হচ্ছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ। প্রতিপাদ্য—‘বেশি বেশি মাছ চাষ করি, বেকারত্ব দূর করি’। বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে নতুন করে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় মাছ চাষের নতুন সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। পাশাপাশি বিদ্যমান সাফল্য ধরে রাখতে নদী রক্ষা ও প্লাবনভূমির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
সারা বিশ্বেই মাছ উৎপাদনে সবচেয়ে উত্কৃষ্ট উৎস নদী। প্রায় আড়াই লাখ টন ইলিশ আসে নদী থেকে, যা মোট ইলিশের প্রায় অর্ধেক। এটি বৃদ্ধির জন্য অভয়াশ্রমগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। এদিকে মুক্ত জলাশয়ের মূল উৎস প্লাবনভূমি। প্লাবনভূমির মূল মাছ কার্পজাতীয়। এ জলাশয়গুলোতে মাছ উৎপাদন বাড়াতে পানি দূষণমুক্ত করতে হবে। মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণেই নদী থেকে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নদী দূষণের কারণে মাছ উৎপাদন কমছে। নদী শাসন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে যেখানে-সেখানে বাঁধ দেয়ার ফলে প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি কোনোভাবেই বিল-বাঁওড় বা প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করতে পারছে না। পাশাপাশি ইটিপি স্থাপনসহ শিল্প বর্জ্য দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দখল ও ভরাটকৃত নদী, পুকুর, দীঘি ও জলাশয়গুলো সংস্কার করে চাষের আওতায় আনা কঠিন কিছু নয়।
আশার কথা, সরকার হাওর-পার্বত্য-উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েছে। মাছকে নিরাপদ রাখার জন্য অভয়াশ্রম ও সংরক্ষণ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। নদীতে মাছের প্রজনন যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য প্রশাসন ও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমন্বিতভাবে কাজ করছেন। মৎস্য খাতে উপযুক্ত পদক্ষেপের কারণে দেশীয় প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক মাছ ও অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদের বিস্তার ঘটছে। এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়, যেমন নদ-নদী, প্লাবন ভূমি, হাওর-বাঁওড় ইত্যাদিকে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। প্লাবনভূমিতে মাছ চাষে বাংলাদেশের মডেল কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা। একই জমিতে মাছ ও ধান চাষ করা মডেলটি দেশব্যাপী প্রশংসিত। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিবেচনা করে মডেলটি দেশের অন্যত্র বিবেচনা করা যেতে পারে।
পাশাপাশি হাতেগোনা কয়েকটি প্রজাতির চাষকৃত মাছের পরিবর্তে অধিক পুষ্টি ও খনিজ সমৃদ্ধ নদীকেন্দ্রিক মাছ উৎপাদনে জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষের মোট প্রাণিজ আমিষের চাহিদার অর্ধেকের বেশি এখন মাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারী ও শিশুদের অপুষ্টির হার এখনো বেশি; তা কাটিয়ে উঠতে মাছের অবদান দিন দিন বাড়ছে।করোনার প্রভাবে মৎস্যসম্পদে যে ক্ষতিটুকু আমাদের হবে, তা পুষিয়ে উৎপাদন আরো বাড়াতে হলে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় যেমন নদ-নদী, প্লাবনভূমি, সুন্দরবন হাওর-বাঁওড়, কাপ্তাই লেক ইত্যাদি জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক চাষ ব্যবস্থার আওতায় আনা জরুরি। মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার লক্ষ্যে নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন হবে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ বর্তমানে ৫৮টি দেশে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করছে। মানসম্মত পণ্য রফতানির লক্ষ্যে পরীক্ষার জন্য মৎস্য পরিদপ্তরের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় আন্তর্জাতিক মানের তিনটি মান নিয়ন্ত্রণাগারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে মৎস্য ও মৎস্যজাতীয় পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। একে আরো বেগবান করতে গবেষণা ও মান পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো জরুরি।
এ কথা অনস্বীকার্য যে মিঠা পানির মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্রের ব্যাঘাত করা না হলে প্রাকৃতিকভাবেই উভয় শ্রেণীর মাছ উৎপাদন বাড়বে। আমাদের অভ্যন্তরীণ জলাভূমি রয়েছে। সেখানে মাছের প্রজনন ও বিচরণের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হলে মাছের অফুরন্ত অভ্যন্তরীণ ভাণ্ডার তৈরি হবে। দেশীয় প্রজাতির মাছ খুঁজে বের করে প্রাকৃতিক বা বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রজনন ঘটিয়ে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। নতুন নতুন স্থানে আরো মাছের অভয়াশ্রম স্থাপন প্রয়োজন। এছাড়া বিলের সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপনের উপযুক্ত প্রকল্প অব্যাহত রাখা দরকার। নদী ক্যাপিটাল ড্রেজিং, খাল খনন, বিলের উপযুক্ত স্থানে অভয়াশ্রম স্থাপনে অগ্রাধিকার প্রদান জরুরি। এছাড়া মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় ছোট মাছ অবমুক্তির প্রকল্প নিতে হবে। আমাদের মৎস্য গবেষণা ফসল খাতের তুলনায় অনেকটাই কম। মৎস্য অধিদপ্তরের জনবল সংকটের কথা শোনা যায়। সংস্থাটির জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে তদারকির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
মাছ চাষ ও অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদন স্থিতিশীল হলেও এ খাতে আগামীতে অনেক বিনিয়োগ আবশ্যক। এ খাতে ঋণপ্রবাহও অনেকটা সীমিত। যেসব আমদানি পণ্য মাছের খাবার তৈরিতে ব্যবহার হয়, তাতে শূন্য শুল্কারোপ, ট্যাক্স হলিডে অব্যাহত রাখার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। দেশের উৎপাদন ‘হাব’গুলোয় মাছ স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি তৈরি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি জরুরি। এখানে সরকারকে অবশ্যই দৃশ্যমান সহায়তা করতে হবে। উন্নত দেশগুলোয় ফিশ ফিলেট খুব জনপ্রিয় খাবার। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতি বছর বিদেশে যে পরিমাণ মিঠা ও লোনা পানির মাছ রফতানি করছি, এর এক-দশমাংশও যদি ফিশ ফিলেট করে বিদেশে পাঠাতে সক্ষম হই, তাহলে শুধু প্রক্রিয়াকরণের কারণেই অনেক উচ্চমূল্যে রফতানি করতে সক্ষম হব। অনুরূপভাবে অন্যান্য মাছও প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে টিনজাত করে রফতানি করা গেলে এ খাত থেকে রফতানি আয় বহুগুণ বাড়বে।

Post a Comment

0 Comments