বাংলাদেশে ই-কমার্সের সমস্যা ও সম্ভাবনা (E-commerce in Bangladesh )

বাংলাদেশে ই-কমার্সের সমস্যা ও সম্ভাবনা



 ই-কমর্স

বর্তমানে অন্যতম আলোচিত ও সবার আকর্ষণের বিষয়বস্তু হলো ই-কমার্স। জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এটি। এর যাত্রা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই নতুনত্বের সংস্পর্শে এসেছেন। দুই দশক আগেও বাংলাদেশে ই-কমার্সের তেমন ব্যাপকতা ছিল না, কিন্তু বর্তমানে খরচ ও সময় কম হওয়ার কারণে সবাই ই-কমার্সের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। ই-কমার্স ধারণাটি আমাদের সবার কাছে পরিচিত। অনলাইনের মাধ্যমে আমরা যখন কোনো পণ্য কেনাবেচা করি, তখন তাকে ই-কমার্স বলে।
করোনা পরিস্থিতিতে এর প্রসার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। শাটডাউনের ফলে ধাপে ধাপে দোকানপাট সবকিছু বন্ধ করে রাখার কারণে সবার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছে ই-কমার্স। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে একজন ব্যবসায়ী এখন নিজস্ব দোকান বা শপিং মল থাকার পরেও ই কমার্সের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছেন। ই-কমার্স মূলত সব ব্যবসায়ীর জন্য অবশ্যপালনীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ই-কমার্সের পথযাত্রা ও বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করলেই বাংলাদেশের সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা করা যায়।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের গুরুত্ব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ই-কমার্স সম্ভাবনাময় দিক উম্মোচন করেছে। দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি, বিকাশ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এটা ইতিবাচক দিক। ঘরে বসে অল্প কিছু সময়ের মধ্যে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করার সুবিধা থাকায় বিক্রেতারা যেমন লাভবান হচ্ছেন, ক্রেতাদেরও সরাসরি বাজারে গিয়ে পণ্য ক্রয় করতে হচ্ছে না। প্রায় প্রতি বছর দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান। বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনার আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাসহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বেকারত্বের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীসহ যারা করোনার কারণে চাকরি হারিয়েছেন বা কর্মসংস্থান হারিয়েছেন, তারা ই কমার্সের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেকারত্ব নামক অভিশাপের অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন।
নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে এই সেক্টরে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায় এবং তাদের কাজের সফলতাও আশানুরূপ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেসব তরুণ-তরুণী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে সরে ঘরে বসে অনায়াসে দিন যাপন করছিলেন এবং যাদের মাথায় ছিল অনেক চিন্তার ভার, তারা ওই উদ্যোক্তার খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। কেননা জীবনের এই পর্যায়ে এসে পরিবারের দায়িত্ব নেয়া এবং বাবা-মায়ের পাশে অর্থনৈতিক সহায়ক হিসেবে থাকা মধ্যবিত্ত সন্তানদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ই-কমার্স করোনা পরিস্থিতিতে এসব শিক্ষার্থীর সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে আমাদের দেশের সম্ভাবনার হার অনেক বেশি এবং যদি এই ই-কমার্সের প্রসার আগামী দিনগুলোয় আরও বৃদ্ধি করা যায় এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে যে বিরাট পরিবর্তন আসবে সেটা সত্যিই সবার জন্য একটা সুখবর।
ই-কমার্স বলতে শুধু অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা বোঝায় না, এটা দ্বারা অনলাইনে কেনাকাটা, ওয়েবডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং ও ফেসবুকে কেনাকাটা সবই বোঝায়। ই-কমার্সের ওপর সবার এই নির্ভরতার অন্যতম কারণ হলো পণ্যের সহজলভ্যতা ও পণ্য সম্পর্কে বিশদ তথ্য। পণ্য সম্পর্কে কোনো তথ্য না জেনে আমরা সশরীরেও সেই পণ্যটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করি না। আর এখানে যেহেতু প্রশ্ন অনলাইনে কেনাকাটার, তাই পণ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য যাচাই করা একটা বড় বিষয়, যে সুবিধা আমরা ই-কমার্সের কাছ থেকে পেয়ে থাকি। এই বিশ্বাসযোগ্যতার কারণেই মানুষ ই-কমার্সের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। যেমনভাবে বিক্রেতারা তাদের সঠিক তথ্য দিয়ে পণ্যটি বিক্রি করতে সক্ষম হচ্ছেন, ঠিক তেমনিভাবেই একজন ক্রেতা সঠিক তথ্য জানা এবং যাচাই করার মাধ্যমে সেটা ক্রয় করার একটা আস্থাভাজন জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন।
এমন অনেক পণ্য আছে যেগুলো সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি না। যেহেতু ই-কমার্স চালু হওয়ার আগে আমাদের কোনো জিনিসের প্রয়োজন হলে সেটা সম্পর্কে আমরা সশরীরে তথ্য যাচাই করতাম, তাই আমাদের অজানা অনেক পণ্য থেকে যেত। এমন পণ্যগুলো সম্পর্কে আমরা এখন ই-কমার্সের মাধ্যমে খুব সহজেই জানতে পারছি। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দূরত্ব অনেক বড় একটা বিষয়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একজন মানুষের যদি কোনো পণ্যের প্রয়োজন হয়, সেটা রাজধানী ঢাকা শহরে এসে ক্রয় করা তার পক্ষে যতটা কঠিন ছিল, এখন সেটা অনায়াসে সে ক্রয় করতে পারে। ই-কমার্সের সুবাদে এসব মানুষের জন্য এক নতুন জগতের দ্বার উšে§াচিত হয়েছে।
যদি কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়, তাহলে ই-কমার্স এক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখছে। বিগত কয়েক বছরে ই-কমার্সের মাধ্যমে যে পরিমাণ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অভাবনীয় বিষয়। নতুন করে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫০ হাজার মানুষের। মূলত ই-কমার্সের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতার আরও একটি দিক হলো করোনাকালে ক্রেতাদের চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করা। নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রী ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষেত্র বিশেষে ৩০০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যদি বিগত বছরগুলোর দিকে একটু লক্ষ করি তাহলে দেখতে পাব, ২০১৯ সালেও দেশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। ২০২০ সালে এসে সেই প্রবৃদ্ধি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ বছর দেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা বহুগুণ বেড়ে গেছে গত বছরে তুলনায়। অর্জিত সুনাম, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তারা গ্রাহকদের জন্য মানসম্মত, উন্নত ও দ্রুত সেবা নিশ্চিত করছে। ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ জানিয়েছে, ২০২০ সালের শেষ আট মাসে (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর) ই-কমার্সে শুধু নিত্যপণ্য লেনদেন হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকার। বর্তমানে প্রতিদিন এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি ডেলিভারি দিতে হচ্ছে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা

এতগুলো দিক বিবেচনার পরেও মনে প্রশ্ন আসতে পারে, বাংলাদেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা কতটা? ই-কমার্সের মধ্যে অনেকে সংশয় ও সফলতা থাকলেও বাস্তবতা বলছে, এখানে ই-কমার্সের সম্ভাবনা অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। আগামী দিনগুলো অনেক সম্ভাবনাময় ই-কমার্সের জন্য। বলা যায়, এ দেশের খুচরা ব্যবসার সিংহভাগ ক্রমেই ই-কমার্সের আওতায় চলে আসবে, এমনকি করপোরেট ব্যবসারও অনেক কিছু। বিষয়টা এমন নয় যে, ই-কমার্স জগতে কেউ না জেনে বুঝে প্রবেশ করে সফলতা অর্জন করছে। কিছু সংশয় রয়েছে যেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তবে এগুলো কাটিয়ে উঠে যদি যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে সফলতা অর্জনের এই পর্যায়কে আরও উন্নত করা যায়, তাহলে এটার সম্ভাবনা আমাদের দেশে সর্বোচ্চ হবে। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে যে ঘাটতি রয়েছে সেটি হলো, সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পর্যাপ্ত ও কার্যকর নীতিমালা, যেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরশীলতার পরিচয় হবে। এই নীতিমালা গ্রহণের পর সেটা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে ই-কমার্সের যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা অর্জন করা সম্ভব হবে।

Post a Comment

0 Comments