আফিম যুদ্ধ: চীনের স্বাধীনতার উপর এক কলঙ্কিত অধ্যায়
‘আফিম যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়েছিল চীন আর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন এর মধ্যে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত। এই যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দখল করে আছে যা তৎকালীন চীনের স্বাধীনতাকে খর্ব করে দিয়েছিল। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন ছিল কৃষি প্রধান স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। একারনে তাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষ করে আমদানির ব্যাপারে ছিল প্রবল অনাগ্রহ। তারা শুধুমাত্র সোনা,রুপা আর আফিম আমদানি করতো। উল্লেখ্য যে চীনের মানুষ তখন আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যাবহার জানত না বরং তারা তা ব্যবহার করতো ছোটখাট রোগের চিকিৎসার ঔষধ হিসেব। এই আফিম তারা মুলত আমদানি করতো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।
ব্রিটিশরা অনেক কাঠ খড় পুরিয়ে চীনে ব্যবসা করার সুযোগ পায়। তারা সেখানে শুধু মাত্র সোনা আর রুপার ব্যবসা করলেও যখন বুঝতে পারে যে চীনে বেশ আফিমের চাহিদা আছে তখন তারা সোনা রুপার সাথে চোরাচালানের মাধ্যমে আফিমও আনতে থাকে। মূলত চীনের জনগণ ব্রিটিশদের থেকেই আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা শিখে। মাদক হিসেবে ব্যাবহারের ফলে আফিমের চাহিদা আরো বেড়ে যায় চীনে।
এমতাবস্থায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে তারা উপমহাদেশের বর্তমান বাংলাদেশসহ বিভিন্ন প্রদেশে আফিমের চাষ করাতে লাগলো ও চোরাই পথে তা চালান করতো চীনে। প্রথমদিকে আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণির মধ্যে। তবে খুব শীঘ্রই তা ছড়িয়ে পরে সকল স্তরের জনগণের মধ্যে। ফলে আফিম চীনে এক ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। এমনকি চীনের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যও আফিমে আসক্ত হয়ে পরে।
আফিমের এই মারাত্মক অবস্থা বুঝতে পেরে চীনের তৎকালীন প্রতাপশালী রাজা চিয়া চিং ১৮০০ সালে আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু ততদিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। আফিম সেবনের পাশাপাশি ততদিনে অনেকেই আফিম ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পরেছে যার মধ্যে ছিল অনেক রাজকর্মচারীও। চীনের মানুষ তখন এতটাই আফিমে আসক্ত যে দেদারছে চলতে থাকে আফিমের বেচাকেনা। ১৮০০ সালে চীনে মাত্র দুই হাজার পেটি আফিম আমদানি করা হত। কিন্তু ১৮৩৮ সালে তার পরিমান গিয়ে দাড়ায় চল্লিশ হাজার পেটিতে। প্রতি পেটিতে ১৪০ থেকে ১৬০ পাউন্ড পর্যন্ত আফিম থাকত বলে জানা যায়।
সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি হয় কোয়াংটুং ও ফুকিয়েন প্রদেশে। সেখানে প্রতি দশ জনের মধ্যে নয় জনই আফিমে আসক্ত হয়ে পরে। আফিম তখন চীনের অর্থনীতি আর যুবসমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। কঠিনতম ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তখনকার মাঞ্চু সম্রাটের। সম্রাট তখন কেন্টন বন্দরে নিয়োগ দেন দেশপ্রেমিক ও সাহসী কর্মকর্তা লিন-সে-সু কে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই বেশ কিছু কঠিন পদক্ষেপ নেন। কিন্তু তাতেও থামানো যায়নি আফিমের ভয়াবহতা।
এমতাবস্থায় ১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ লীন কেন্টন বন্দর অবরোধ করেন এবং সেখানে থাকা সকল বিদেশি বণিকদের কাছে মজুদ থাকা অবৈধ আফিম জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই বণিকরা তা জমা দেন। লীন বাজেয়াপ্ত করা প্রায় বিষ হাজার পেটি আফিম লবন আর চুন দিয়ে ধ্বংস করে দেন যার মূল্য ছিল তৎকালীন প্রায় ছয় মিলিয়ন টেইল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশরা সেখানে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়। দেশপ্রেমিক চীনারা সেই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরলেও ব্রিটিশদের উন্নত অস্ত্র আর রণ কৌশলের সামনে পেরে উঠেনি। উপরন্ত চীনের অনেক সেনা সদস্য আফিমে আসক্ত থাকায় ঠিকমত যুদ্ধও করতে পারেনি। যুদ্ধে বিশ হাজার চীনা সৈনিকের বিপরীতে মাত্র পাঁচশত ব্রিটিশ সেনা নিহত হন। যুদ্ধে হেরে মারাত্মক পরিণতি বরন করে নিতে হয় চীনাদের। চীনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বন্দর ব্রিটিশদের ছেড়ে দিতে হয়, দিতে হয় পুরো চীনে ব্যবসা করার অনুমতি আর হংকং কে যুক্ত করা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। এসবই হয়েছিল ‘নানকিং চুক্তি’র মাধ্যমে।
এখন অবশ্য হংকং পুনরায় চীনের সাথে যুক্ত এবং হংকং এর অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে কম্যুনিস্ট চীনকে নিতে হয়েছে ‘এক দেশ দুই নীতি’ কার্যক্রম। হংকং এর অর্থনীতি তাই এখনো পুঁজিবাদী যেখানে সমগ্র চীন অনুসরন করে কমিউনিজম। আর হ্যা দেশপ্রেমিক লীনকেও দেয়া হয়েছিল নির্বাসন। আফিম যুদ্ধ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদের কথা, তৎকালীন সময়ে তাদের শোষণের কথা। চীনাদের বহুদিন ভুগতে হয়েছে এই আফিমের জন্য। আজকের পৃথিবীতে আফিমসহ সকল ধরনের মাদক দ্রব্য আরো বেশি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এর উচিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আরো বেশি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা।
আফিম যুদ্ধ
চীন আর ব্রিটেনের মধ্যে ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল প্রথম আফিম যুদ্ধ বা ফার্স্ট ওপিয়াম ওয়ার। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে চীন ছিল কৃষিপ্রধান স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ফলে আমদানিতে তাদের ছিল প্রবল অনাগ্রহ। তারা শুধু সোনা, রুপা আর আফিম আমদানি করত। সে সময় আফিম যে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা জানত না চীনারা। তারা আফিম ব্যবহার করত ছোটখাটো রোগের চিকিৎসার ওষুধ হিসেব। এই আফিম আসত মূলত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।
এদিকে ব্রিটিশ বণিকদের কাছে চীনের চা, সিল্ক এবং চিনামাটির বাসন অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা ছিল। কিন্তু চীনারা কেবল রৌপ্যের বিনিময়ে তাদের পণ্য বিক্রি করত। ফলে ব্রিটেনের প্রচুর রুপা চীনের কাছে চলে যায়। এটা বন্ধ করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও অন্য ব্রিটিশ বণিকেরা ভারতে উৎপাদিত আফিম অবৈধভাবে চীনে পাচার করতে শুরু করে। এর বিনিময়ে তারা রুপা নিত। সেই রুপা দিয়ে চীনের চা, সিল্ক কিনত। একসময় চীনের জনগণ ব্রিটিশদের কাছ থেকেই আফিমকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করা শেখে। ফলে আফিমের চাহিদা আরও বেড়ে যায় চীনে।
আফিমের এই মারাত্মক অবস্থা বুঝতে পেরে চীনের তৎকালীন প্রতাপশালী রাজা চিয়াচিং আফিমের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তত দিনে বেশ দেরি হয়ে গেছে। আফিম সেবনে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন অনেক রাজকর্মচারীও। এমন পরিস্থিতিতে রাজা ক্যান্টন বন্দরে লিনসে-সু নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেন। ১৮৩৯ সালের ১০ মার্চ লিনসে-সু ক্যান্টন শহরের বিদেশি বাণিজ্য অঞ্চল অবরোধ করেন। তিনি বেআইনিভাবে রক্ষিত ব্যাপক পরিমাণ আফিম জব্দ করেন। আফিম ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে চীন আক্রমণ করে ব্রিটিশরা। চীন সেই যুদ্ধে হেরে যায়। চীনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বন্দর ব্রিটিশদের ছেড়ে দিতে হয়। সেই সঙ্গে পুরো চীনে ব্যবসা করার অনুমতি এবং হংকংকে যুক্ত করা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে।
এই কারণেই, সম্রাট দাওগুয়াং এই পদার্থের আসক্তি দ্বারা সৃষ্ট মহামারীটি শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এইভাবে, তিনি শক্তি প্রয়োগ করে এমনকি সর্বত্র আফিমের প্রবেশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আদেশ দিয়েছিলেন।
এই কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত একজন ছিলেন লিন হসে সো, যিনি তাঁর প্রথম পদক্ষেপে তাঁর লোকদের বিশ হাজার বাক্সের আফিমের একটি ক্যাশে ধ্বংস করতে পাঠিয়েছিলেন।
এর পরে, তিনি রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে একটি বার্তা প্রেরণ করেন যাতে তাকে দেশে মাদক আনার চেষ্টা বন্ধ করতে এবং তাকে বাণিজ্য বিধিমালার প্রতি সম্মান জানাতে বলেন।
ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়া ভুয়া ছিল: 1839 সালের নভেম্বরে পুরো নৌবহর হংকংয়ে আক্রমণ করেছিল, চীনা নৌবাহিনীর বাড়ি। এটিই ছিল প্রথম আফিম যুদ্ধের সূচনা।
দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ
প্রথম আফিম যুদ্ধে চীনের পরাজয় প্রায় সীমাহীন ইউরোপীয় বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। এছাড়াও ক্ষতিপূরণ হিসাবে ব্রিটিশরা হংকংকে নিয়েছিল।
চীনের অবমাননার অনুভূতি বিভিন্ন দ্বন্দ্ব নিয়েছিল; তবে তথাকথিত দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের প্রাদুর্ভাবের বরং একটি দুর্বল অজুহাত ছিল।
হংকং-নিবন্ধিত জাহাজের সাথে একটি অন্ধকার ঘটনা ব্রিটিশদের পুনরায় যুদ্ধ ঘোষণার দিকে পরিচালিত করেছিল। জাহাজটি চীনা আধিকারিকরা ছিলেন এবং তার ১২ জন ক্রু (এছাড়াও চীনা) জলদস্যুতা ও পাচারের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছিল।
ইংরেজরা দাবি করেছিল যে, হংকংয়ের নিবন্ধভুক্তি হ'ল, এই ক্যাপচার প্রথম যুদ্ধের পরে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলি ভেঙে দিয়েছে। যখন এই যুক্তি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, তখন তারা ঘোষণা করেছিল যে চীনা প্রহরীরা ব্রিটিশ পতাকার অবমাননা করেছে।
যাই হোক না কেন, তারা এশীয় দেশের বিভিন্ন অবস্থানের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা শীঘ্রই ফরাসিদের সাথে যোগ দিয়েছিল, এই অঞ্চলে একটি ধর্মপ্রচারক হত্যার জবাব দেওয়ার পক্ষে যুক্তিযুক্ত।
অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ
পুরো বিষয়টির নীচে ছিল অঞ্চলটিতে আধিপত্যের লড়াই। একজন ব্রিটিশ কনসাল 19 বিংশ শতাব্দীর শেষে নিম্নলিখিত বিবৃত:
"যতক্ষণ না চীন আফিম ধূমপায়ীদের একটি দেশ হিসাবে থাকবে, আফিমের অভ্যাস জাতির শক্তি এবং প্রাণশক্তিকে নষ্ট করে দেয়, তা আশঙ্কার কারণ নেই যে এটি যে কোনও ওজনের সামরিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।"
যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় শক্তি এশিয়ার সমস্ত অংশে বসতি স্থাপন করেছিল, উপনিবেশ স্থাপন করেছিল এবং বাণিজ্যিক ও সামরিক উভয়ই ক্ষমতার অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
ফলাফল
নানকিন চুক্তি
চীনের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া প্রথম আফিম যুদ্ধের পরে, প্রার্থীরা নানকিনের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল, যা শান্তির শর্ত নির্ধারণ করেছিল।
এশীয় দেশ আফিম সহ নিখরচায় বাণিজ্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এটিকে আরও সহজ করার জন্য, তাকে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক বহরে পাঁচটি বন্দর খুলতে হয়েছিল। এছাড়াও, চুক্তিতে হংকংয়ের গ্রেট ব্রিটেনের দেড়শ বছরের জন্য অধিবেশন অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তিয়ানজিন চুক্তি
তথাকথিত দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের প্রথম লড়াইয়ের পরে 1858 সালে এই নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। আবার চীনারাও কেবল ব্রিটিশ নয়, অন্যান্য পাশ্চাত্য শক্তি যারা অংশ নিয়েছিল তাদের সমস্ত দাবী গ্রহণ করতে হয়েছিল।
এই ছাড়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বেইজিংয়ে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস খোলা, এমন এক শহরে যেখানে বিদেশীদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে, নতুন বন্দর বাণিজ্যের জন্য সক্ষম করা হয়েছিল এবং পশ্চিমা দেশগুলিকে ইয়াংটি নদী এবং অভ্যন্তরীণ চিনের কিছু অংশ দিয়ে যাতায়াত করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
বেইজিং কনভেনশন
দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের চূড়ান্ত সমাপ্তি এটি একটি নতুন চুক্তি নিয়ে আসে। আলোচনা চলাকালীন পশ্চিমা দেশগুলি বেইজিং দখল করছিল এবং পুরাতন গ্রীষ্ম প্রাসাদটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
চীনের চূড়ান্ত পরাজয়ের ফলে যে পরিণতি হয়েছিল তার মধ্যে আফিম ও তার ব্যবসায়ের মোট বৈধতা রয়েছে। এছাড়াও, বাণিজ্যের উদারকরণ আরও গভীরতর করা হয়েছিল, পশ্চিমা শক্তিগুলির পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল পরিস্থিতি।
অবশেষে, খ্রিস্টানরা তাদের নাগরিক অধিকারকে স্বীকৃত, চীন নাগরিকদের রূপান্তর করার চেষ্টা করার অধিকার সহ স্বীকৃত দেখেছিল।
0 Comments