শেষের কবিতা গ্রন্থ সমালোচনা
শেষের কবিতা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শেষের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের চিত্রসৃষ্টি পর্যায়ের দ্বিতীয় উপন্যাস এটি। ১৯২৭ খ্রী: এর ভাদ্র থেকে ১৯২৮ খ্রী: এর চৈত্র অবধি 'প্রবাসী' তে ধারাবাহিকভাবে রচনাটি প্রকাশিত হয়।
পটভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিকতাঃ
'শেষের কবিতা' বাংলার নবশিক্ষিত অভিজাত সমাজের জীবনকথা। ব্যক্তি মানুষের মূল্যচেতনার উপাদান যদি অন্তর থেকে শুধুই বার হয়ে আসতে থাকে; যার সমুন্নতি ও দীপ্তি বিদ্যার বৃহৎ পরিমার্জনায় , তারও একটা চরিত্র আছে। বাস্তব চেনাশোনার চলা বাহ্যিক অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে তা একেবারে অন্তর অভিমুখী। এই নবতর চেতনার অদ্ভুত আবিষ্কার এই উপন্যাস রচনার কাছাকাছি সময়ে। রবীন্দ্রনাথের অঙ্কিত এই পর্বের দু-এ কটি মুখাবয়বে কল্পনার প্রাধান্য লক্ষণীয়।
শেষের কবিতা'র বিষয় বস্তুঃ
বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার অমিত রায় ('অমিট্ রে') প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এবং রোমান্টিক যুবক। তর্কে প্রতিপক্ষকে হারাতে সিদ্ধহস্ত। এই অমিত একবার শিলং পাহাড়ে গেল বেড়াতে । আর সেখানেই এক মোটর-দুর্ঘটনায় পরিচয় ঘটল লাবণ্যর সাথে। যার পরিণতিতে এল প্রেম। কিন্তু অচিরেই বাস্তববাদী লাবণ্য বুঝতে পারল অমিত একেবারে রোমান্টিক জগতের মানুষ যার সঙ্গে প্রতিদিনের সাংসারিক হিসেব-নিকেশ চলে না। ইতিমধ্যে শিলং এ হাজির হয় কেটি (কেতকী)। হাতে অমিতর দেওয়া আংটি দেখিয়ে তাকে নিজের বলে দাবী করে সে। ভেঙে যায় লাবণ্য-অমিতর বিবাহ-আয়োজন। শেষ পর্যন্ত অমিত স্বীকার করে যে, লাবন্যর সাথে তাঁর প্রেম যেন ঝরনার জল -প্রতিদিনের ব্যবহারের জন্য নয়। আর কেতকীর সাথে সম্পর্ক ঘড়ায় রাখা জল- প্রতিদিন পানের উদ্দেশ্যে।
শেষের কবিতা'র প্রধান চরিত্র
শেষের কবিতা'র প্রধান চরিত্র অমিত রায়।অমিতর মধ্যে যেটি প্রবল সেটি হল প্রগল্ভতা। সেটিই তাঁর ছদ্মবেশ। সে কবি বা আর্টিস্ট কোনটাই নয় , আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্যেই তাকে এই মুখোশ পরতে হয়েছে। 'রবিবার' এর অভীক এবং 'প্রগতি সংহার' এর নীহারের সঙ্গে অমিতর স্বভাবের একটা মিল আছে। অমিতর সহচর কেটি। আর্বানিটির আড়ষ্ট কৃত্রিমতা নিয়ে সে একেবারে ভিন্ন জাতের। তার মুখের মধ্যে একটা শ্রেণীজ্ঞাপক (type) মুখোশের লক্ষণ বর্তমান। 'আর্বান আরিস্টক্রাসি'র বিপরীত হল 'রিয়েল আরিস্টক্রাসি'। অবনীশ দত্ত, লাবণ্য, শোভনলাল, যতিশঙ্করকে নিয়ে যথার্থ আভিজাত্যের পরিচয়টি সম্পূর্ণ হয়েছে বিদ্যাপরিমার্জিত অন্তর্জিজ্ঞাসু প্রবণতায়। শুধু যোগমায়া এদের দুই শ্রেণীর থেকে একেবারে আলাদা , উনিশ শতকীয় জীবনঐতিহ্যের নিশ্চিত দিশারী সে।
শেষের কবিতা'র শৈল্পিক সমালোচনাঃ
রবীন্দ্রনাথের শেষজীবনে ছবি আঁকার কালে কথাসাহিত্যের চিত্রধর্মে কিছু কিছু নূতনত্ব দেখা গেছে, যা আগে ঠিক এমনভাবে দেখা যায় না। কলমের স্বল্প আচড়ে বক্তব্যকে নিশ্চিতভাবে চোখের সামগ্রী করে তোলার এক বিশেষ ঝোক এবং সেই সঙ্গে দক্ষতা চোখে পড়ে।
১. 'কমল-হীরের পাথরটাকে বলে বিদ্যে , আর ওর থেকে যে আলো ঠিকরে পড়ে ,তাকে বলে কালচার। পাথরের ভার আছে, আলোর আছে দীপ্তি।'
২. ' সায়াহ্নের এই পৃথিবী যেমন অস্ত-রশ্মি-উদ্ভাসিত আকাশের দিকে নি:শব্দে আপন মুখ তুলে ধরেছে, তেমনি নীরবে, তেমনি শান্ত দীপ্তিতে লাবণ্য আপন মুখ তুলে ধরলে অমিতের নতমুখের দিকে।
0 Comments