গণদেবতা উপন্যাস

গণদেবতা উপন্যাসের বিষয়বন্তু

বাংলা ভাষার অন্যতম কথাসাহিত্যিক তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় রচিত একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় উপন্যাস গণদেবতা । ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে এই উপন্যাসটিকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তরুণ মজুমদার এই উপন্যাসের কাহিনী উপজীব্য করে গণদেবতা শিরোনামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাংলা উপন্যাসের একটি বলে বিবেচিত এই উপন্যাসটি বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত পঞ্চগ্রাম উপন্যাসটিকে পরবর্তীকালে গণদেবতা'র অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্রাম’ দুটি ভিন্ন উপন্যাস হিশাবে আমরা পড়ি। আসলে কিন্তু দুটো দুই খণ্ডে লেখা একই উপন্যাস। এক অংশের নাম ‘চণ্ডীমণ্ডপ’, অপর অংশের নাম ‘পঞ্চগ্রাম’। এই দুই অংশের একসঙ্গে সাধারণ নাম ‘গণদেবতা’। কিন্তু ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ অংশের নাম করণ ‘গণদেবতা’। সেই নামেই উপন্যাসখানি মশহুর। কিন্তু তাই বলে ‘গণদেবতা’ এই খণ্ডাংশের নয়, দুই খণ্ড মিলে নাম।
বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বাংলা উপন্যাসের একটি বলে বিবেচিত এই উপন্যাসটি বহুভাষায় অনূদিত হয়েছে।

গণদেবতা

গণদেবতা উপন্যাসের কাহিনী

গণদেবতার কাহিনির সময়কাল ১৯২৬ সাল থেকে শুরু হয়ে বিস্তৃত পরবর্তী প্রায় এক দশক পর্যন্ত। এক অস্থির সময় ছিল সেটা। প্রথম মহাযুদ্ধ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে জগত-সংসার-সমাজে। সে আগুনের আঁচ থেকে রেহাই পায়নি শহর, গ্রাম কোনোটাই। অভাব-ক্ষুধা চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে মানুষকে। গরীব আরও গরীব হচ্ছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে—উদ্ভব হচ্ছে অনেক নতুন ভুঁইফোঁড় ধনীর।
বাইরের দুনিয়ার অস্থিরতার ছোঁয়া থেকে মুক্ত নয় গ্রাম-গঞ্জও—তেমনই এক গ্রাম শিবকালিপুর। গ্রাম বাংলার নীরব নিভৃত এক গ্রাম শিবকালিপুর। কিন্তু যুগের ধাক্কায় টাল-মাতাল আজ সেই গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবন—নতুন আর পুরাতনের দ্বন্দ্বে দ্বিধাবিভক্ত আজ সেই গ্রাম। কারও মন টানে পুরাতন সংস্কার ধরে রাখতে, আবার কারও মন টানে নতুনের আহ্বানে পুরাতনকে বিসর্জন দিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে। অভাবের তাড়নাটা সবসময়ই প্রথম ধাক্কা মারে গরীবদের বুকে। গণদেবতায়-ও অভাবের প্রথম শিকার গরীবরাই—গরীব কামার অনিরুদ্ধ আর ছুতার গিরিশ অভাবের ধাক্কায় গ্রাম থেকে ব্যবসা একরকম গুটিয়ে ব্যবসা খোলে শহরে। এ নিয়ে গ্রামে তোলপাড়—সব গেল! সব গেল! রব। কিন্তু কেউ বুঝতে চাইল ওদের পেটের দায়!
সেই গ্রামে নতুন-পুরাতনের, অভাব-অনাহারের দ্বন্দ্বের ধাক্কা লাগল, সেই ধাক্কায় একে একে ভেঙে পড়তে গ্রমাএর প্রচলিত সংস্কার। সেই ধাক্কায় টালমাটাল হয়ে গেল অনেকের জীবন।
একদিন কাশীপুর গ্রামের কামার অনিরুদ্ধ এবং ছুতোর গিরিশ পুরনো নিয়ম ভেঙে গ্রাম ছেড়ে শহরের বাজারে এসে দোকান ফেঁদে বসে। এত দিন ধরে পেয়ে আসা সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে ভেবে গ্রামের মানুষ অসন্তুষ্ট হয়। প্রতিবিধানের আশায় গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে সভা ডাকা হয়। উঠতি ধনী শ্রীহরি পাল বা ছিরু পাল জোট পাকায়। ফলে ছিরুর সঙ্গে অনিরুদ্ধের সংঘর্ষ বাধে। ছিরু অপমানিত হয়। পরদিন ভোরে জানা যায়, অনিরুদ্ধের জমির ফসল রাতে কারা কেটে নিয়ে গেছে। অনিরুদ্ধ সব বোঝে কিন্তু ছিরুর প্রভাব প্রতিপত্তির ভয়ে কিছু করতে না পেরে হতাশায় মদ্যপান ধরে এবং জৈব প্রবৃত্তির কাছে আত্ম সমর্পণ করে। চণ্ডীমণ্ডপ পাঠশালার পণ্ডিত, গ্রামের সকল ভাল কাজের অংশী ও সংগী দেবনাথ ঘোষ পরম বেদনায় অনুভব করে চণ্ডীমণ্ডপের শাসন নীতির অচল অবস্থা। এখন ছিরুপালদের মতো সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিদের ক্ষমতাই প্রবল।
তারই ধারাবাহিকতায় উত্থান হলো গল্পের নায়ক দেবনাথ ওরফে দেবুর। আমূল পরিবর্তন এল দেবুর স্ত্রী বিলি, অনি কামার, পাতু, অনি কামারের বউ পদ্মর জীবনে।এক সময় মড়কে গ্রাম উজাড় হয়ে যায়, দেবুর পরিবার ধ্বংস হয়।নিঃসঙ্গ বিষণ্ণ দেবু উপলব্ধি করে প্রাচীন গ্রামীণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সঙ্গে নতুন প্রজন্মের উদ্ভবের সত্যরূপ।
যুদ্ধ আর অস্থির নতুন সময়টা আবার অনেক নতুন মানুষেরর জন্ম দিয়েছিল, যারা বুক ফুলিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বন্দি যতী এ উপন্যাসে সেই নতুন যুগের মানুষদের প্রতিনিধি।
আরেক দল মানুষ ছিল যারা অতীতের সব জ্ঞান, অভিজ্ঞতা নিয়ে মহীরুহের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকেন নতুন প্রজন্মের কাছে সসব হস্তান্তর করে নতুন-পুরাতনের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্যে। ন্যায়রত্ন গণদেবতায় সেসব মহীরুহের প্রতিচ্ছবি।ক্ষয়িষ্ণু সামস্ত তান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলে আধুনিক কলকারখানার প্রসার এবং তার ফলে চণ্ডীমণ্ডপের বিধি নিষেধ বা সনাতন নিয়ম নীতি লঙ্ঘন—এই ভাবটি উপন্যাসটির মূল বক্তব্য বিষয়।

গণদেবতা উপন্যাসের চরিত্র

একটি গ্রামের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত উপন্যাসটি। গ্রামের নাম শিবকালীপুর। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ময়ুরাক্ষী নদী। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিম্ন সম্প্রদায়ের বায়েন আর বাউড়ি। সাথে উচ্চ বর্ণের কয়েকটি ঘর। আর গ্রামের একজন মহাজন।
উপন্যাসটিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সংখ্যা অনেক। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মাঝে পন্ডিত দেবু ঘোষ, দেবুর স্ত্রী বিলু, মহাজন শ্রীহরি ঘোষ, অনুরুদ্ধ কামার, অনুরুদ্ধের স্ত্রী পদ্ম, যোগেন ডাক্তার, ব্রাক্ষ্ণন হরেন ঘোষাল, নজরবন্দী যতীন আর স্বৈরিনী দুর্গা।
এসকল চরিত্রের মাঝে পন্ডিত দেবু ঘোষ সবার থেকে আলাদা। এই নিস্তেজ, দরিদ্র আর ভয়সর্বস্ব মানুষের গ্রামে পন্ডিত দেবু ঘোষ প্রথম প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ জ্বালায়। সরকারী কানুগগোর অসম্মানের প্রতিবাদ করে যে নীরব কারা বরণ করে। যেখানে একটিবার মৌখিক ক্ষমা প্রার্থনায় দেবু ঘোষ দীর্ঘ ১৫ মাসে কারাগারের শাস্তি হতে মুক্তি হতে পারতো। দেবু ঘোষ ক্ষমা স্বীকার করেনি।
মহাজন শ্রীহরি ঘোষের যখন বার বার ঘুনে ধরা নিয়মকে হাতিয়ার করে দরিদ্র বায়েন আর বাউড়িদের বঞ্চনা করেছিলো, নিয়ে চলেছিল তাদের বেঁচে থাকার একটমাত্র অবলম্বন গবাদিপশুগুলো তখন মুখে অনেকে অনেক কিছু বললেও শুধু এগিয়ে এসেছিলো পন্ডিতে দেবু ঘোষ। আর গ্রামের অতিথি নজরবন্দী যতীন দেবু ঘোষের বুকে লুকিয়ে থাকা বিপ্লবের আগুনকে উস্কের দিয়েছে বার বার।
যে বায়েন বাউড়িদের উচ্চ বর্ণের হিন্দুরা কুকুরের থেকেও অধম চোখে দেখত। সেই মানুষগুলো জন্য কলেরায় আক্রান্ত হলো মৃত্যুঝুকি জেনেও এগিয়ে এসেছিলো পন্ডিত। সেজন্য পন্ডিত দেবু ঘোষকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিলো। তবুও পন্ডিত দেবু ঘোষ থামেনি। যারা জন্মের পর ন্যায়ের সংজ্ঞা অনুসন্ধান করে তারা হয়তো থেমে যায় কিন্তু যারা ন্যায়কে বুকে ধারণ করে জন্মায় তারা থামে না। থামতে পারেনা।
আরেকটি চরিত্র সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। সে হলো বায়েন সম্প্রদায়ের দুর্গা। দুর্গার আগুন ও জল দুই আছে উক্তিটির ব্যপ্তিপুরো উপন্যাস জুড়ে। কখনো সে সমাজের নিয়মের তোয়াক্কা না করে সমাজের চোখে নিজেকে করেছে কলঙ্কিনী আবার কখনো পন্ডিত দেবু ঘোষ, বিলু, পদ্ম, যতীন, ভাই পাতু আশপাশের মানুষগুলো আগলে রেখেছে পরম মমমতায়।

গণদেবতা উপন্যাসের নামকরণ

গণদেবতার বাংলা অভিধানের দুইটি অর্থ আছে, প্রথমটি হলো যে সমাজের গণই দেবতা অর্থাৎ ক্ষমতার অধিকারী। দ্বিতীয়টি হলো গণশক্তির অধিদেবতা। এই উপন্যাসটিতে দ্বিতীয় অর্থটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সহস্র বছরের শাসন আর শোষণের রীতিকে যে রক্তচক্ষু দেখিয়ে যে মাথা তুলে দাঁড়ায়, হাজার মানুষের ঝুঁকে যাওয়া কপালের মাঝে যার কপালের শিরার রক্ত টগবগিয়ে ওঠে, যে সংসার, সম্মান, প্রাণ সবকিছু তুচ্ছ করে মানুষেরর জন্য নিজের সামর্থ্যে হাজার টুকরো করে ছড়িয়ে দেয় মানুষের মাঝে সেই গণদেবতা। আর এমন এক গণদেবতাকে নিয়েই লেখক উপন্যাসটি লিখেছেন।
ঋদ্ধ সমালোচকদের মতে, নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্বে ঝনঝনানি সবচেয়ে ভালো ফুটে তারাশঙ্করের কলমে; এ ব্যাপারে তাঁর সমতুল্য বাংলা সাহিত্যে আর কেউ নেই। গণদেবতা সমালোচকদের সেই বক্তব্যকে করেছে সুদৃঢ়।আপাত দৃষ্টিতে গণদেবতা একটি সামাজিক উপন্যাস হলে শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা থেকে এমন কিছু লেখা সম্ভব নয়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল গভীর জীবন দর্শন এবং গ্রামীণ অর্থ ও সম্পদের বন্টন ব্যবস্থার উপর গভীর জ্ঞান। ছিল গ্রাম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহন কিংবা উপস্থিতি। উপন্যাসটি জুড়ে আছে কিছু ছোটগল্প। গল্পগুলিকে ঘিরেই লেখক উপন্যাসের মূলভাব আরও জোরালো করে উপস্থাপন করেছেন।পুরানো যুগের রীতিনীতি, সংস্কৃতি আর নতুনের জোয়ারের দ্বন্দ্ব পুরো উপন্যাসের কাহিনিকে এগিয়ে নিয়েছে সুনিপুণভাবে, গণদেবতাকে করে তুলেছে সার্থক এক উপাখ্যানে।
বিংশ শতাব্দীর সেরা ঔপন্যাসিকদের মাঝে নিঃসন্দেহে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একজন। এইকালের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন গুনমুগ্ধ পাঠক ছিলেন। বিখ্যাত চরিত্র হিমুর যে ব্যক্তিগত নদীটির নামকরণ করা হয়েছে সেটি সম্ভবত এই উপন্যাসের ময়ুরাক্ষী নদী থেকে। এছাড়াও উনার ম্যাজিক মুনশি বইটিতে আমরা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাইনী ছোটগল্পটি দেখতে পাই।
উপন্যাসে একটি উক্তি আমার সবথেকে ভাল লেগেছে, উক্তিটি হলো,
ধর্মকে তুমি বন্দী করো কর্মের বন্ধনে ।

Post a Comment

0 Comments