পদ্মা নদীর মাঝি-সমালোচনা

 পদ্মা নদীর মাঝি-সমালোচনা

পদ্মা বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী। ... শহর থেকে দূরে এ নদী এলাকার কয়েকটি গ্রামের দীন-দরিদ্র জেলে  মাঝিদের জীবনচিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। জেলেপাড়ারর মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-অভাব-অভিযোগ - যা কিনা প্রকৃতিগতভাবে সেই জীবনধারায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা এখানে বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রিত হয়েছে।

পদ্মা নদীর মাঝি-সমালোচনা


কাহিনী সংক্ষেপ :

পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের পটভূমি বাংলাদেশের বিক্রমপুর-ফরিদপুর অঞ্চল। উপন্যাসে পদ্মার তীরবর্তী কেতুপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের পদ্মার মাঝি ও জেলেদের জীবনচিত্র সুনিপুণভাবে অঙ্কিত হয়েছে। শহর থেকে দূরে এ নদীর তীরবর্তী জেলেপাড়ারর মাঝি ও জেলেদের জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-অভাব-অভিযোগ - এই উপন্যাসে খোদিত হয়েছে বিশ্বস্ততার সঙ্গে ।

আলোচনা-সমালোচনা-পাঠপর্যালোচনা :

জীবনঘনিষ্ঠ কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মা নদীর মাঝি' বাংলা উপন্যাসের জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এই উপন্যাসে তিনি পরিমিত ও পরিমাপিত বাক্যব্যঞ্জনায় পদ্মাপাড়ের জেলেদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের ছবি অংকন করেছেন। মানিকের লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মেদবাহুল্যতা বর্জন এবং সাংবাদিকসুলভ নির্লিপ্ততা ও নির্বিকারত্ব । সমকালীনদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য হলো তিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার জুড়ে কোনো চরিত্রের বর্ণনা দিতেন না । তুলির এক আঁচড়েই যেন এঁকে ফেলতে চাইতেন সব । সাহিত্যে তাঁর মিতব্যয়িতা বোঝাতে গিয়ে জনৈক অধ্যাপক বলেছিলেন, 'পদ্মা নদীর মাঝি' শরৎচন্দ্রের হাতে পড়লে চার খন্ডের শ্রীকান্ত হয়ে যেত !' তাঁর এই পরিমিতিবোধের মূল কারণ ছিল তিনি নিছক লেখার উদ্দেশ্যে লিখতেন না, একটি আদর্শকে সামনে রেখে লিখতেন।

ব্যক্তি জীবনে মানিক ছিলেন মার্ক্সবাদী আদর্শের অনুসারী, সেইসঙ্গে তাঁর মনন ছিল ফ্রয়েডীয় চেতনায় লালিত।

তাই আমরা যখন 'পদ্মা নদীর মাঝি'র স্বার্থকতা বিচার করব তখন দেখব এটি লেখকের চিন্তা-আদর্শের ভিত্তিতে কতটুকু স্বার্থক। এক্ষেত্রে, লেখকের আদর্শের সঙ্গে সহমত হওয়াটা জরুরী নয়।

সেই বিচারে 'পদ্মা নদীর মাঝি'র মূল্য বিচার করলে এক বিস্ময়কর ফলাফল পাওয়া যায় । মানিক যেভাবে দারিদ্র- ক্লেষকে এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন তা শরৎ কিংবা বিভূতিভূষণের চেয়ে কোনো অংশে কম করুণ নয়। কিন্তু তাঁদের লেখা পড়ে চোখে পানি আসলেও সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় উল্লেখ থাকেনা । সেই বিবেচনায় মানিককে ওপরেই রাখতে হয় এজন্য যে, তিনি এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের একটা পথ দেখিয়েছেন। যদিও তাঁর দেখানো পথ নিয়ে বিতর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয় । তাঁর মতে, একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রই পারে সমাজের বঞ্চনাপীড়িত মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে । তাই তিনি নিজের চিন্তাকে প্রতিফলিত করেছেন হোসেন মিয়ার চরিত্রে। হোসেন মিয়া কুবের কপিলাকে তার কিনে নেওয়া ময়না দ্বীপে পাঠিয়ে দেয় । ময়না দ্বীপ আসলে একটি কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রেরই প্রতিকী রূপ, লেখকের স্বপ্নের ইউটোপিয়া । এখানে কুবের যেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নোবেলজয়ী উপন্যাস 'The Old Man and The Sea' এর সেই বৃদ্ধ মাঝির মতো যে শত প্রতিকূলতার মাঝেও নতুন দিনের স্বপ্ন দেখে । মার্কসবাদের আদর্শ ম্যাক্সিম গোর্কির 'মা' কিংবা ফিওদর দস্তয়ভস্কির 'ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট' উপন্যাসেও আমরা পাই। কিন্তু রাশিয়া মার্কসবাদের জন্মভূমি বলে তাঁদের উপন্যাসে এটির খোলামেলা উপস্থিতি। কিন্তু এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক একটা সূক্ষ্মতা ও দক্ষতার সাথে মার্কসবাদকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন যে, সাহিত্যের মানও ক্ষুণ্ণ হয়নি, মাঝে থেকে একটা ভিনদেশী রাজনৈতিক মতাদর্শকে একটি সামাজিক উপন্যাসে এত শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে মানিকের মুন্সিয়ানা তাকে ম্যাক্সিম গোর্কিদের মতো গ্রেট নভেলিস্টদের কাতারে নিয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না ।

জেলে জীবনের সুখ-দুঃখকে নিঁখুতভাবে রূপায়িত করতে এবং তাদের মুখের আঞ্চলিক ভাষাকে সঠিকভাবে তুলে আনার জন্য লেখক কেতুপুর গ্রামে থেকেছেন, জেলেদের সাথে মিশেছেন। লেখকের এই অকৃত্রিম নিষ্ঠা আমাদেরকে মুগ্ধ করে ।

মানিক সম্ভবত ‘Art for art sake’ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁর কাছে বৈধ-অবৈধ কোনো বিষয় নয়, শৈল্পিকতা সৃজন করতে গিয়ে তিনি আদিমতার অন্ধকারে ঢুকে যেতেও কুণ্ঠিত হননি । তাইতো কুবের- কপিলার মতো শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের অবৈধ প্রেমকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছেন, লালন করেছেন, এমনকি পরিণতিও দিয়েছেন।

সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ক্ষোভ লুকানোর চেষ্টা করেননি মানিক-‘ ঈশ্বর থাকেন ওই গ্রামে, ভদ্রপল্লীতে । এখানে তাঁহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না ।’

নারী চরিত্রের রহস্যময়তা লেখকের কলমে ফুটে উঠেছে স্বার্থকভাবে । পদ্মার মতো রহস্যময়ী কপিলা স্বামীগৃহে ঘোমটা টানা বধু যে কিনা কুবেরের দিকে নুয়ে পড়ে অবাধ্য বাঁশের কঞ্চির মতো । শ্বশুরবাড়িতে কপিলাকে আনতে গেলে বলে, ‘মনডার অসুখ মাঝি, তোমার লাইগা ভাইবা ভাইবা কাহিল হইছি ।’ কিন্তু কুবের যখন বলে, ‘তর লাইগা দিবারাত্র পরানডা পোড়ায় কপিলা’, তখন খোলসের মধ্যে ঢুকে যায় কপিলা- ‘ক্যান মাঝি ক্যান? আমারে ভাব ক্যান? সোয়ামির ঘরে না গেছি আমি? আমারে ভুইলো মাঝি...গাঙ এর জলে নাও ভাসাইয়া দূর দ্যাশে যাইয়ো মাঝি, ভুইলো আমারে ।’ কিন্তু কুবেরকে ভুলতে বলে কপিলা নিজেই ভুলতে দেয় না তাকে। ‘শ্যামাদাস না কুবের' অর্থাৎ বৈধ না অবৈধ এই দ্বন্দে জড়িয়ে পড়ে কপিলা । এবং কী আশ্চর্য! শেষ পর্যন্ত অবৈধটাই বেছে নেয় সে । ‘আমারে নিবা মাঝি লগে’ বলে চিরসঙ্গী হয় কুবেরের ।

তবে এতকিছু সত্ত্বেও নৈতিকতা নিয়ে লেখকের চিন্তাধারা পাঠককে দ্বিধান্বিত করে । শেতলবাবুর মধ্যে লোক ঠকানোর প্রবণতা থাকায় লেখক তাকে ঘৃণিত করে তুলে ধরেছেন । অপরদিকে অবৈধ পন্থায় হোসেন মিয়া আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে তবু তার প্রতি লেখকের কোনো ঘৃণা নেই । বরং নিজেই আশ্রয় নিয়েছেন তার মধ্যে । কারণ একটাই, হোসেন মিয়া মানবপ্রেমী । অর্থাৎ ব্যাপারটা যেন এরকম, ন্যায়-অন্যায় কোনো বিষয় না, মানবপ্রেম থাকলেই চলবে ।

বাংলা সাহিত্যের সমকালীন লেখকদের মধ্যে একটা প্রবণতা ছিল উপন্যাসের মধ্য দিয়ে সুন্দর একটা গল্প বলার । কিন্তু মানিক যেন অনেকগুলো স্ন্যাপশটকে একত্রে জোড়া দিয়েছেন । কাহিনীর মধ্যে যে গতিময়তা, যে ক্লাইম্যাক্স থাকা দরকার তা যেন মানিকের রচনায় কিছুটা বিবর্ণ । তাঁকে কাহিনীর প্লটের চেয়ে চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক চিত্রায়ণের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে দেখি । এ কারণে রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎ এর মতো তাঁর গল্পের বুনট সঙ্ঘবদ্ধ মনে হয় না ।

শেষের দিকে এসে মনে হয় তিনি যেন স্বপ্নের ইউটোপিয়া কায়েম করার ব্যাপারে তাড়াহুড়া করেছেন । সাতকুড়ি তেরটাকা ভর্তি একটা ঘটি চুরির ঠুনকো অজুহাতে লেখক কুবেরকে চিরদিনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন ময়নাদ্বীপে । কারাবরণের ভয়ে ঘর সংসার ছেড়ে চিরনির্বাসনে যাওয়াটা কিছুটা বাস্তবতার পরিপন্থি বৈকি! একটি বাস্তবধর্মী উপন্যাসের ফিনিশিং এমন ফিকশনধর্মী হওয়াটা কিছুটা বেমানানই বলব। তবে সমসাময়িক প্রেক্ষাপট থেকে সামগ্রিক বিবেচনায় বলা যায়, পদ্মা নদীর মাঝি একটি নিরীক্ষাধর্মী সামাজিক উপন্যাস- যেখানে সমাজতন্ত্র, মনোসমীক্ষণবাদ ইত্যাদি বহু বিষয়ের মিশেল ঘটেছে যথার্থ অনুপাতে । স্রোতের বিপরীতে গিয়ে বাংলা উপন্যাস নিয়ে এমন দুঃসাহসিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা মানিকের ভেতরের ‘ড্যামকেয়ার’ সত্ত্বাটিকে ফুটিয়ে তোলে । আজ উত্তরাধুনিক যুগে এসে ঔপন্যাসিকদের লেখায় যে বিষয়গুলো প্রতিভাত হয় মানিক সেই সময়ই সেগুলো নিয়ে পরীক্ষা করেছেন । সে কারণে এই দাবি করলে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে, মানিক কালের আগে জন্মেছিলেন । ( সংগৃহীত)  

Post a Comment

0 Comments