নতুন মেরুকরণের পথে বিশ্বরাজনীতি!

 

নতুন মেরুকরণের পথে বিশ্বরাজনীতি!
রাশিয়ার ইউক্রেন হামলার নিন্দা জানাতে নিরাপত্তা পরিষদে গত শুক্রবার খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ওই প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল ভারত, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইতিমধ্যে ব্রাজিল, পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ বুঝিয়ে দিয়েছে তারা রাশিয়ার পক্ষে। বিশ্বরাজনীতিতে কি নতুন মেরুকরণ ঘটতে যাচ্ছে?

বিশ্বরাজনীতি
বিশ্বরাজনীতি


পুতিনের আগ্রাসন
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। এ নিয়ে বিশ্বে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠলেও নির্বিকার ছিলেন তিনি। পাত্তা দেননি পশ্চিমা বিশ্বের নিষেধাজ্ঞা। ক্রিমিয়া দখলের আট বছর পর চলতি বছরের শুরু থেকে প্রতিবেশী দেশ গোটা ইউক্রেনই দখলে নিতে উঠেপড়ে লাগেন তিনি। শুরুতে ইউক্রেন সীমান্তে লাখ লাখ সেনা মোতায়েন করে যুদ্ধের দামামা বাজান তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো তার দখলদারি তৎপরতার নিন্দা জানালেও থামেননি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। পশ্চিমা বিশ্বের হুঁশিয়ারি বা নিষেধাজ্ঞায় কর্ণপাত করেননি এই শাসক। ইউক্রেনে হামলার পেছনে পুতিনের যুক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পাঁয়তারা করছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তার এই উদ্যোগ রাশিয়ার নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। এ ছাড়া পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে (একসঙ্গে দনবাস নামে পরিচিত) বসবাসরত রুশভাষী মানুষদের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব রাশিয়ার ওপরই বর্তায়। এসব যুক্তি সামনে এনে আঞ্চলিক পরিস্থিতি চরম উত্তেজনার দিকে ঠেলে দেন পুতিন। উত্তেজনার একপর্যায়ে গত মাসে দনবাসের রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষ চলাকালেই বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা দনবাসের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে পুতিনের কাছে অনুরোধ জানান। তাদের অনুরোধের কয়েক ঘণ্টা পর ২১ ফেব্রুয়ারি দনবাসের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে দেন পুতিন। একই সঙ্গে ওই অঞ্চলে রুশ সেনাবাহিনী পাঠানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর তিন দিন পর ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলার নির্দেশ দেন পুতিন। তার এই সিদ্ধান্তে খোদ রাশিয়ার মানুষই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ইউক্রেনে আগ্রাসন বন্ধে মস্কোর রাস্তায় নামলে তাদের ওপর চড়াও হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তার হন হাজারখানেক রাশিয়ান।
নিরাপত্তা পরিষদ
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর গত শুক্রবার পুতিনের কর্মকাণ্ডের কড়া ভাষায় নিন্দা জানাতে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে খসড়া প্রস্তাব হাজির করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও আলবেনিয়া যৌথভাবে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে। সেই প্রস্তাবে ভোট দিয়ে সমর্থন জানায় ১১টি দেশ। আর তিনটি দেশ ভোট দেওয়া থেকে নিজেদের বিরত রাখে। এই তিন দেশ হলো ভারত, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, রাশিয়ার আগ্রাসনের কড়া সমালোচনা করা থেকে দিল্লি বিরত থাকবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব উভয়ের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও আরেক স্থায়ী সদস্য রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তাবে ভেটো দেয়। নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবে স্থায়ী সদস্যদের মধ্যে কেউ ভেটো দিলে তা আর পাস হওয়ার সুযোগ থাকে না।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ড জানান, খসড়া প্রস্তাবটি ১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করা হবে। সেখানে রাশিয়ার ভেটো দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। ভোটের পর রাশিয়ার দূতের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনি এই প্রস্তাবে ভেটো দিতে পারেন কিন্তু আমাদের প্রতিবাদে ভেটো দিতে পারবেন না। সত্য, নীতি-নৈতিকতা, ইউক্রেনের সাধারণ জনগণ ও জাতিসংঘের সনদ আপনি কীভাবে ভেটো দিয়ে আটকে দেবেন?’
চাপে ভারত
নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়াকে নিন্দা জানিয়ে খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার বিষয়ে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি বলেন, ‘ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সহিংসতা ও শত্রুতার দ্রুত অবসান ঘটাতে সব ধরনের উদ্যোগ নিতে আমরা আহ্বান জানাই। বিরোধ নিরসনে আলোচনাই একমাত্র পথ। দুঃখের বিষয়, কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আশা কেউ দেখছেন না। আমাদের অবশ্যই আলোচনায় বসতে হবে। এসব কারণে খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত।’ ইউক্রেনে মস্কোর পদক্ষেপের নিন্দা জানাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপে রয়েছে দিল্লি। অন্যদিকে ভারতে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূতও দিল্লির কাছ থেকে ইউক্রেনে হামলার সমর্থন চাইছেন।
গত সপ্তাহে দিল্লিতে শিল্পোন্নত শীর্ষ সাত দেশের (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপান) জোট জি-৭-এর রাষ্ট্রদূতরা সংহতির উদ্দেশ্যে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত আইগোর পলিখার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে রাশিয়ার ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে প্রকাশ্যে অনুরোধ জানান পলিখা। সাক্ষাতের বিষয়ে ভারতে জার্মান রাষ্ট্রদূত ওয়াল্টার জে লিন্ডনার টুইটবার্তায় বলেন, ‘ভারতে জি-৭-এর সাত রাষ্ট্রদূতসহ ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূত ইউক্রেনের জনগণের প্রতি সংহতি জানাতে মিলিত হন। বৈঠকে রাশিয়ার অযৌক্তিক সামরিক আগ্রাসন সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান হয়। শান্তি, শৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক আইনের পক্ষে সরব হওয়ার এখনই সময়।’ রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ সম্পর্কে দিল্লির নিরপেক্ষতা নিয়ে বৈঠকে অংশ নেওয়া ভারতীয় কর্মকর্তাদের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ওই রাষ্ট্রদূতদের কয়েক জন। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে ভারতের অবস্থান কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা চলছে।’
এদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে শুক্রবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকাকে প্রশংসা করে মস্কো। অবশ্য রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহিংসতা বন্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন। পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপে সব পক্ষকে আলোচনায় বসারও আহ্বান জানান মোদি। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়নি ভারত সরকার। পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো যাতে এ কারণে ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ না হয়, এ জন্য ইউক্রেন বিষয়ে যতটুকু না করলে বা না বললেই নয়, ঠিক ততটুকুই করার সিদ্ধান্ত ভারত নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঘনিষ্ঠতা উভয় পক্ষে
বিশ্ব রাজনীতি এ মুহূর্তে বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনের জনগণের পাশে থাকার অঙ্গীকার দিয়েও শেষ মুহূর্তে থাকেনি, নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে দায়িত্ব সারছে। আর অন্যদিকে ইউক্রেনে হামলা করে শক্তি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ফের রাশিয়ার আবির্ভাব ঘটেছে। রাশিয়ার পক্ষ নেবে না কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের পক্ষ নেবে তা নিয়ে চরম দোটানায় রয়েছে ভারত। কারণ দুই পক্ষই তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ভূ-রাজনীতির কৌশলগত অংশীদার। ভারতের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। ভারতের বিপদে অস্ত্র সরবরাহে দেরি করে না মস্কো। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০সহ ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে বড় ধরনের অবদান রাখছে রাশিয়া। ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ সংক্রান্ত উত্তেজনার মধ্যে মস্কো সফরে যান ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। এ ছাড়া ভারতের অভ্যন্তরীণ সব বিষয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বরাবরই দিল্লির পক্ষ নেয় মস্কো।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বের ইতিহাস দীর্ঘ। বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রযুক্তিসহ অন্য আরও খাতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে ভারত। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ইউরোপের দেশগুলোর সঙ্গেও। এ ছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু ফ্রান্স। সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) চীনের সঙ্গে লড়াই করতে গেলে এই বন্ধুদের দরকার ভারতের। ইউক্রেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থান নিলে ভারত কী অর্জন করবে বা খোয়াবে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে হেলে পড়ার নীতি কতটা সুফল বয়ে আনবে এসব নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মহলে বিতর্ক চলছে। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়, রাশিয়া-ইউক্রেন বিষয়ে ভারত আগামীতেও নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখলে ক্ষিপ্ত হয়ে পশ্চিমা বিশ্ব চাইলেও দিল্লিকে দূরে ঠেলতে পারবে না। কারণ ভারতের বাজার তাদের দরকার। এ ছাড়া চীনকে মোকাবিলায়ও ভারতকে প্রয়োজন পশ্চিমাদের।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর থেকে নিত্যনতুন ঘটনা প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ব। এসব ঘটনার কিছু ছিল প্রত্যাশিত। আবার রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির নেতৃত্বে যে দেশটির সাধারণ জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, তা পুতিনসহ অনেকের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। এমনকি ইউক্রেনের এমপিদের অস্ত্র হাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করতে দেখা গেছে। রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে একের পর এক কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমা দেশগুলো। এসব বিবেচনায় নিয়ে ইউক্রেন ঘিরে ভারত তার অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে সামনে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে খসড়া প্রস্তাবে ভোট দিতে ভারত বিরত নাও থাকতে পারে বলে ধারণা তাদের। গত শুক্রবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবের ভোটের পর সংস্থাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূত লিন্ডা টমাস গ্রিনফিল্ড যৌথ এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘ইউক্রেনে কেন রাশিয়া আগ্রাসন চালাল তার জবাব দিতে মস্কোকে বাধ্য করার জন্য এই প্রস্তাব অকপট ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে অবস্থান করা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সংস্থাটির সনদের পক্ষে কি না, তা খসড়া এই প্রস্তাবের ভোটের মাধ্যমে পরিষ্কার হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনে একাই হামলা চালিয়েছেন। তাকে তার কর্মকাণ্ডের জবাব দিতে হবে।’
চীন ও আমিরাতের অবস্থান
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল চীনও। রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভকে ফোন করেন। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় দেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। ভারতের মতো ভূ-রাজনীতিতে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে চীন সরকারও। এরই অংশ হিসেবে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভকে ফোন করা হয়। এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার সমর্থন বা নিন্দা কোনোটাই জানায়নি পেইচিং। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভূ-রাজনীতির স্বার্থে পুরো ঘটনায় নীরব থাকবে চীন। ফোনে আলাপের সময় রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াংকে জানান, মিনস্ক চুক্তির অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো। এ কারণে ইউক্রেনে হামলা চালানো হয়। জবাবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং বলেন, ‘সব দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে শ্রদ্ধা করে পেইচিং। একই সঙ্গে ইউক্রেনের সমস্যা যে বেশ জটিল ও ঐতিহাসিক, তা আমরা অবগত রয়েছি। রাশিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগ যৌক্তিক বলে আমরা মনে করি।’ তবে সংকট নিরসনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করার চেয়ে আলোচনা ও সমঝোতা পেইচিং চায় বলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান ওয়াং। তিনি বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধের মানসিকতা পরিহার করার পক্ষে চীন।’ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কমানোর চেষ্টা করছে রাশিয়া ও চীন। এ লক্ষ্যে দেশ দুটি একজোট। গত মাসের শুরুতে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পেইচিং সফরে যান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের সঙ্গে গ্যাস রপ্তানিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয় তার। বৈঠক শেষে যৌথ এক বিবৃতিতে আদর্শিক প্রশ্নে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছিলেন শি ও পুতিন।
ভারত ও চীনের মতো নিরাপত্তা পরিষদে খসড়া প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতও। দেশটির এই অবস্থানকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমিরাতের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। রাশিয়ার হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে গত শুক্রবার খসড়া প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র। মিত্র দেশটির এই উদ্যোগে আমিরাতের সাড়া না দেওয়া অবাক করে অনেককে। আবার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই ঘটনাকে খুব একটা অপ্রত্যাশিত হিসেবে দেখছেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমিরাতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও গত বছর উপসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের কর্মকাণ্ড ও দ্বৈত মনোভাব হতাশ করে আমিরাতকে। বিশেষ করে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের আমিরাতের আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ পার্শ্ববর্তী তেল সংরক্ষণাগার স্থাপনায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তিন জনকে হত্যা করার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নীরব ভূমিকা বিস্মিত করে আমিরাতকে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আগের মতো আস্থা রাখতে পারছে না আমিরাত। এসব কারণে পরাশক্তি দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনা করছে আমিরাত, যার ইঙ্গিত দেশটি দেয় নিরাপত্তা পরিষদে খসড়া প্রস্তাবে ভোট না দেওয়ার মাধ্যমে। কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়া ইঙ্গ-মার্কিন অক্ষের বিপরীতে চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে শক্তিশালী অক্ষ সৃষ্টিতে বিশ্ব রাজনীতিকদের তৎপরতা ইউক্রেন ইস্যু আরও একবার সামনে নিয়ে এলো।

Post a Comment

0 Comments