দার্শনিক রেনে দেকার্ত এবং তাঁর দার্শনিক মতবাদ সমূহ

 

দার্শনিক রেনে দেকার্ত এবং তাঁর দার্শনিক মতবাদ সমূহ


আমরা আলোচনা করবো, মধ্যযুগের বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের জীবনী এবং তার সমস্ত দার্শনিক মতবাদ নিয়ে। রেনে দেকার্ত ছিলেন বুদ্ধিবাদী দার্শনিক! এই পর্বে আমরা তার জীবনী, পেশা জীবন, তার রচিত বই; তার বিভিন্ন মতবাদ, তত্ত্ব এবং রেনে দেকার্তের অবদান সহ দেকার্তের উপর সম্ভাব্য ৪০টি প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে আলোচনা করবো।

র‍্যনে দেকার্ত (ফরাসি: René Descartes) একজন ফরাসি দার্শনিক, গণিতজ্ঞ এবং বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি পাশ্চাত্যের প্রথম আধুনিক দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃত। তিনি একজন দ্বৈতবাদী দার্শনিক ছিলেন। তাছাড়া তিনি জ্যামিতি ও বীজগণিতের মধ্যকার সম্পর্ক নিরূপণ করেন, যার দ্বারা বীজগণিতের সাহায্যে জ্যামিতিক সমস্যা সমাধান সম্ভব হয়।



রেনে দেকার্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী:

রেনে দেকার্ত (Rene Descartes) ফ্রান্সের টুরাইন প্রদেশের ল্যা হ্যাই (La Haye) নামক সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে ৩১ শে মার্চ ১৫৯৬ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। দেকার্তের বাবা ছিলেন পেশায় একজন ‍ডাক্তার এবং পার্লামেন্টের সদস্য।

জন্মের সময়ই রেনে দেকার্ত তার মাকে হারান! ছোট বেলা থেকেই দেকার্ত ছিলেন দূর্বল ও রোগা প্রকৃতির! তার ৮ বছর বয়সে তিনি জেস্যুইট স্কুলে (Jesuit school) ভর্তি হন। এই জেস্যুইট স্কুলটি ধনী পরিবারের ছেলেমেয়ের জন্য ৪র্থ হেনরি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন! এই স্কুল থেকেই রেনে দেকার্ত পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন আদব কায়দা; নিয়মশৃঙ্খলা ও সামাজিক শিষ্ঠাচার সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন।

দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য তিনি নিয়মিত প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারতেন না। তবে , তার স্কুলের কর্তৃপক্ষ তা জানতো যে তিনি দূর্বলতার কারণেই সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠতেন! এজন্য তারা দেকার্তকে কিছু বলতো না! এভাবে আস্তে আস্তে তার এই দেড়িতে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস, তার স্থায়ী অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

দেকার্ত ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন অনেক মেধাবী! সেই সময় থেকেই তার গণিত ও জ্যামিতির উপর বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। স্কুলে আট বছর পড়াশোনা করার পরে তিনি গ্রামে ফিরে যান এবং সেখানে এক বছর কাটান।

তার বাবার অনেক অর্থ সম্পদ ছিলো বিধায়, তার বাবা তাকে প্রচুর টাকা দিয়ে এবং তার পড়াশোনার জন্য, একজন গৃহভৃত্য দিয়ে প্যারিসে বসবাস করার জন্য পাঠিয়ে দেন। প্যারিসে আসার পরে রেনে দেকার্ত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার সুযোগ পেয়ে যান; তবুও তিনি কখনো বিশৃঙ্খল জীবন-যাবন করেননি।

তিনি সর্বদা সংযমী ও সৎ জীবন-যাপন করেছেন। তবে; জুয়া খেলার প্রতি দেকার্তের বিশেষ আকর্ষন ছিলো! তিনি একটু মৃতব্যয়িতার সাথে চলতেন বলে, তার এই জুয়া খেলাকে কেউ খারাপ বলেনি!

ছোট বেলো থেকেই রেনে দেকার্ত একা থাকতে ভালোবাসতেন। তবে, একা থাকলেও তিনি কখনো সময় অপচয় করেননি! তিনি তার এই একাকী সময়কে পড়াশোনা ও দর্শনচর্চার ক্ষেত্রে ব্যয় করতেন। তার এই কাজে তাকে সাহায্য করতেন, তারই সহপাঠী, প্রখ্যাত ধর্মযাজক ও গণিতবিদ মেরসেন ! এভাবে তিনি তার শৈশব ও শিক্ষা জীবন অতিবাহিত করেন।

দার্শনিক রেনে দেকার্তের সংক্ষিপ্ত পেশাজীবন:

একাকী জীবন যাপনের অভ্যাস থাকলেও, বিভিন্ন দেশ ভ্রমনের বড় রকমের শখ ছিলো দেকার্তের মধ্যে! আর তিনি এটাও জানতেন যে সৈনিকের চাকরি নিতে পারলে, বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করা তার জন্য অনেক সহজ হবে। এজন্য দেকার্ত ম্যাওরিস অব নাসুর অধিনে সৈনিক পদে চাকরি গ্রহণ করেন! এভাবে রেনে দেকার্ত কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন।

স্পেনের কাছে থেকে স্বাধীন হওয়ার পরে, হল্যান্ড ছিলো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ও সভ্য দেশ! ম্যাওরিস নামক যে ব্যক্তির অধিনে দেকার্ত চাকার নিয়েছিলেন, সেই ম্যাওরিস ছিলেন অনেক উদারনৈতিক; এবং যুদ্ধবিদ্যার পাশাপাশি তিনি গনিত ও বিজ্ঞানের প্রতি অনেক আগ্রহী ছিলেন।

এজন্য ম্যাওরিসের সাথে একদল প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর যোগাযোগ ছিলো; আর সেখানেই রেনে দেকার্ত ২ বছর কাটান! এসময়, দেকার্ত গনিত ও সংগীত বিষয়ে কিছু রচনাবলী, প্রাথমিক ভাবে রচনা করেন। ঠিক এই সময়ই দেকার্ত বুঝতে পেরেছিলেন বীজগণিতকে জ্যামিতিতে প্রয়োগ করার সম্ভাবনা; এবং এর পরে তিনি বিশ্লেষণধর্মী জ্যামিতি আবিষ্কার করেছিলেন।

বোহেমিয়ার প্রোটেস্টান্টদের বিদ্রোহের কারণে ১৬১৯ সালে একটি যুদ্ধ বেধে যায়! ঠিক তখন দেকার্ত ক্যাথলিক সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ক্যাথলিকরা এই যুদ্ধে জয় লাভ করে এবং এর পরে রেনে দেকার্ত তাদের সাথে প্রাগে যান।

কিন্তু, এক সময় সৈনিক জীবনের আনন্দ হারিয়ে দেকার্ত আবার প্যারিসে চলে যান! এরপরে ৩ বছর সেখানেই কাটান। প্যারিসের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় দেকার্তের প্রতি অনেক আকৃষ্ট ছিলো! কিন্তু, তিনি একা থাকতে পছন্দ করতেন বলে, কারো সাথে সঙ্গ দিতেন না; কারণ এতে তার জ্ঞান চর্চার কাজে বিঘ্ন হতো! এই কারনে, দেকার্ত প্যারিস ত্যাগ করেন! এভাবে তিনি মানুষের দৃষ্টির আড়ালে থাকার চেষ্টা করতেন।

১৬২৮ সালে রেনে দেকার্ত হল্যান্ড যান। সেখানে গিয়েও তিনি লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতেন! এজন্য হল্যান্ডে একবার তার বাসা পরিবর্তন করেন। এখানেই তিনি জ্যোতির্বিদ্যা; পদার্থবিদ্যা; রসায়ন; শরীরবিদ্যা; চিকিৎসাবিদ্যা সহ তার পছন্দনীয় বিভিন্ন বিষয়ে নিবিরভাবে জ্ঞানচর্চার সুযোগ পান।

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্তের রচিত বিখ্যাত বই:

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত উল্লেখ্য যোগ্য কিছু বই রচনা করেন। তিনি দর্শন শাস্ত্র, গণিত ও জ্যামিতি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। ১৬৩৭ সালে একই সঙ্গে চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘জিয়োমেট্রি’, ‘ডায়োপট্রিকস’ ‘মেট্রোলজি’ এবং আলোচিত ‘ডিসকোর্স অন মেথড’। 

তার উল্লেখ্যযোগ্য বই হলোঃ

১। ডিসকোর্স অন মেথোড – ১৬৩৭ সাল (Discourse on Method)
২। দি মেডিটেশন অন দি ফার্স্ট ফিলোসোফি – ১৬৪১ সাল (the Meditations on the First Philosophy)
৩। দি প্রিন্সিপাল অব ফিলোসোফি – ১৬৪৪ সাল (the Principles of Philosophy)
৪। The Treatise on the Passions-1650.

দার্শনিক রেনে দেকার্তের মৃত্যু:

বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত ১৬২৯ সাল থেকে ১৬৪৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর হল্যান্ডে ছিলেন! এরমধ্যে তিনি একবার অবশ্য ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে যান! তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালেই দর্শন চর্চা ও গ্রন্থ রচনা করেন।
দেকার্ত হল্যান্ডে থাকা কালীন সেখানকার প্রটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন! প্রটেস্টেন্টদের অভিযোগ ছিলো যে রেনে দেকার্ত নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। হল্যান্ডে নিয়োজিত, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত দেকার্তকে রক্ষা করেন!
এর পরে লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রেনে দেকার্তের উপর আবার অভিযোগ আনেন; তারা দেকার্তকে স্বপক্ষে বা বিপক্ষে কিংবা অনুকূল-প্রতিকূল সকল প্রকার মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে নিষেধ করে দেন! এক্ষেত্রে, প্রিন্স অব অরেঞ্জ দেকার্তকে সাহায্য করেন। সেখানে নিয়োজিত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ছিলেন দেকার্তের বন্ধু; এই বন্ধুর মাধ্যমে সুইডেনের রাণী ক্রিশ্চিয়ানার সাথে দেকার্তের পত্র আদান-প্রদান শুরু হয়।
রাণী ক্রিশ্চিয়ানা দর্শনের অনুরাগী ছিলেন। এক পর্যায়ে রাণী ক্রিশ্চিয়ানা ১৬৪৯ সালে অক্টবর মাসে দেকার্তকে আমন্ত্রণ জানান এবং দেকার্ত রাণীর আমন্ত্রণে সারা দিয়ে সুইডেনের স্টকহোমে চলে যান! এর পর রাণীর ইচ্ছা অনুযায়ী দেকার্ত রোজ ভোরে গিয়ে রাণীর প্রাসাদে রাণীকে দর্শন শিক্ষা দিতেন।
কিন্তু, রেনে দেকার্তের তো আবার দেড়ি করে ছাড়া, সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠার কোনো রকম অভ্যাস ছিলোনা! এজন্য শীতের মধ্যে রোজ রোজ ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রাসাদে যাওয়ার কারণে দেকার্ত খুব অসুস্থ্য হয়ে পরেন! আর এই অসুস্থ্যতার কারনেই, মধ্যযুগীয় বিখ্যাত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক রেনে দেকার্ত ১৬৫০ সালের ফেব্রূয়ারি মাসে মারা যান।

Post a Comment

0 Comments