চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ


চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ

বর্তমান সরকার যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে আছে তথ্য-প্রযুক্তি। এ খাতে দেশ যথেষ্ট এগিয়েও আছে। শহরের সীমা ছাড়িয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির মোবাইল, ইন্টারনেট গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। তথ্য-প্রযুক্তির নানা সুফল ক্রমেই মানুষের কাছে সহজলভ্য হচ্ছে।এখন পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যোগাযোগ করা সহজ হয়েছে। গত এক যুগের ডিজিটাল বাংলাদেশের পথচলা আমাদের আরো আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি করেছে। দেশের তরুণরা এখন শুধু স্বপ্ন দেখে না, স্বপ্ন বাস্তবায়নও করতে জানে। 

বাংলাদেশের অদম্য যাত্রায় অচিরেই গড়ে উঠবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বনির্ভর ও আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ ।তবে আমাদের দেশে দক্ষ প্রগ্রামারের অনেক অভাব রয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তি খাতসহ সব ক্ষেত্রেই খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি আরো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসছে। বিভিন্ন প্রযুক্তির সংমিশ্রণ অর্থনীতি, সমাজ, ব্যবসা ও ব্যক্তিগত জীবনে পরিবর্তন আনছে। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে আরো দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে।

যাঁরা বিদেশে যান তাঁদের কারিগরি বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়। আর এ কারণেই কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সহায়তা করছে। দেশ গড়ার জন্য দক্ষ জনশক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটাই আমরা সব সময় ভাবি এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কাজ করছি। সরকার এমনভাবে জনশক্তি তৈরি করছে, যাতে তারা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের যেকোনো জায়গায় প্রতিদ্বন্দিতা করতে পারে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারে। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

বিশ্বে এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ক্ষুত্র ও শক্তিশালী সেসর, মোবাইল ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেস ও মেশিন লার্নিং চতুর্থ বিপ্লবের মূলশক্তি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গুণগত পার্থক্য আছে, এ বিপ্লবে মেশিনকে বুদ্ধিমান করা হয়েছে। অন্য বিপ্লুবে যন্ত্রকে ব্যবহার করেছে মানুষ আর এ বিপ্লবে যন্ত্র নিজেই নিজেকে চালানোর সক্ষমতা অর্জন করছে; আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেস বা মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে যন্ত্রকে বুদ্ধিমান করা হচ্ছে। মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে যন্ত্রের ধারণক্ষমতা অনেক বেশি এবং প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা অনেক দ্রুত। ইন্টারনেটের কারণে এর কার্যক্রমের আওতা অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। 

বাংলাদেশে বসে একটি বুদ্ধিমান কম্পিউটার যেকোনো দেশের একটি যন্ত্রকে আদেশ দিতে পারে; একটা ঘরের তাপমাত্রা মেপে আদেশ দিতে পারে তাপমাত্রা বাড়ানো বা কমানোর। 

আজকাল পরিধেয় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উপাত্ত সংগ্রহ করে; যেমন_ তাপমাত্রা, রক্তচাপ, পালস, রক্তে শর্করা ইত্যাদি। এ উপাত্ত কম্পিউটার ডাটাবেইসে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে ওই ব্যক্তির চিকিৎসায় ব্যবহার করা যায়।গুগল গ্লাস সীমিত আকারে কম্পিউটারের মনিটরের কাজ করছে। উন্নত বিশ্বে ডাক্তারদের রোগীর সঙ্গে কথোপকথন লিপিবদ্ধ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। ডাক্তাররা নিজে সেই কথোপকথন কম্পিউটারে লিখতেন। অগমেডিক্স নামেরসিলিকন ভ্যালির একটি প্রতিষ্ঠান গুগল গ্লাসের মাধ্যমে ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর কথোপকথন বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেটে পাঠিয়ে দেয়, যা এখানে বসে ইংরেজি জানা কেউ লিপিবদ্ধ করছেন। এই চশমা ধীরে ধীরে মনিটরের স্থান দখল করে নিচ্ছে । 

গ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে প্লাস্টিক, আ্যালুমিনিয়াম, সিরামিক, স্টিল ইত্যাদি তৈরি করা যাচ্ছে। একটি কারখানার কাজ এখন একটি প্রিন্টিং মেশিনে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। আমদানিনির্ভর বাংলাদেশের পোশাকশিল্প থ্রিডি প্রিন্টারে অনেক জিনিস নিজেরা তৈরি করতে পারবে, এতে পরিবহন ব্যয় কমে যাবে, যা পরিবেশদূষণ কমাবে। 

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ pdf

আজকাল পোশাকে চিপস ব্যবহার করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়। ফলে স্বাস্থ্যবিষয়ক বার্তা পাওয়া যায়। মানুষও পোশাকে ঘষা দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য পাঠাতে বা পেতে পারে।কম্পিউটারের প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা বাড়ছে আর দাম কমছে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিতে সের বা চিপস ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা পাঠানো যায় এটা ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি উন্নত বিশ্বে আইওটি নিয়ে অনেক গবেষণা চলছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার গাড়ি, বাসার এসি, ফ্রিজ নির্দিষ্ট সময়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যাবে, ঘরে পছন্দসই তাপমাত্রা ঠিক করছে। রোবট ফ্রিজ থেকে নাশতা মাইক্রোওভেনে গরম করে রাখতে পারবে। ফ্রিজ তার ভেতরে সংরক্ষিত খাদ্যসাম্্রী স্ক্যান করে, খাদ্যাভ্যাস বিবেচনা করে, অনলাইনে ই-কমার্সে অর্ডার প্রদান করতে পারবে; এমনকি পশুর শরীরে চিপস স্থাপন করা যাচ্ছে। এতে গবাদি পশুর শারীরিক অবস্থা, রোগ, প্রজননকাল ইত্যাদি আগেভাগে জেনে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে। আমাদের এ জন্য কম্পিউটার প্রগ্রামার, ডাটা আ্যানালিস্টসহ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতাসম্পন্ন লোকের চাহিদা বাড়ছে।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মুখে বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর  দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘের ই-গভর্নযা্স ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্সে শীর্ষ ৫০টি দেশে থাকার চেষ্টা করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পাঁচটি উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এগুলো হলো ডিজিটাল সেন্টার, পরিষেবা উদ্ভাবন তহবিল, সহানুভূতি প্রশিক্ষণ, টিসিভি ও এসডিজি ট্র্যাকার। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে তরুণরা ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, আযাপভিত্তিক পরিষেবা ও অন্যান্য সংস্থা তৈরি করছে। এ ছাড়া মহাকাশে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটসহ কিছু বড় অর্জন বাংলাদেশকে বিশ্বে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।আ্যাপভিত্তিক নানা ধরনের সেবাও খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দৈনন্দিন কাজ, উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন এমন নানা স্তরে সময়, শ্রম ও ব্যয় কমানোর জন্য এখন অনেকেই প্রযুক্তিকে বেছে নিচ্ছেন। বড় কম্পানিগুলো ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তার (এসএমই) একটি বড় অংশই মোবাইল ত্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করছে। 

মহামারি মোকাবেলা থেকে নানা কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) নানামুখী ব্যবহার দেখছে বিশ্ব। আগামী দিনে ব্যবসার ধারণা আমূল পাল্টে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমন্তানির্ভর নানা প্ল্যাটফর্ম। আগামী দিনগুলোয় চিকিৎসাসেবায়, অফিস-আদালতে, শিল্প-কারখানায়, সংবাদ সংস্থা বা গণমাধ্যমে, ভাষান্তর প্রক্রিয়া, টেলিফোনসেবা, বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, হোটেল-রেস্তোরাঁ; এমনকি বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণকর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র বা রোবটের ব্যাপক ব্যবহারের আভাস দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে আমাদের রিস্কিলিং ও আপক্ষিলিং করতে হবে।



Post a Comment

0 Comments