টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন

 

টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
Table of Content (toc)
বিদেশিদের দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবিক বিপর্যয়, দুর্নীতি, হতাশা আর বিরোধীদের দৃষ্টিতে অকার্যবর দেশ হিসেবে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একসময় চিহ্নিত করা হতো। সচেতন মানুষসহ দেশবাসী কখনোই এমন বিশেষণকে পছন্দ করেনি। গত দশকে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় অর্জন হলো মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং চরম দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনতে পারা। ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৭৫৪ মার্কিন ডলার, আর বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৯১ মার্কিন ডলার। কভিড অতিমারিকালেও আমাদের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দশ বছরে ধারাবাহিকভাবে দারিদ্র্যের হার যেমন কমেছে, তেমনি মানুষের প্রত্যশিত আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিসহ মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু ও জন্মহার টেকসইভাবে কমেছে। জনগণের পুষ্টি বৈষম্য কমেছে। বিদ্যুৎ প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে, স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়াও শিক্ষা বিস্তারের আওতা সম্প্রসারিত হয়েছে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে মানুষ আগের থেকে অনেক বেশি সোচ্চার হয়েছে। এসবই সম্ভব হয়েছে গত দশকে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে, বিশেষ করে গত চার বছরে গড়ে ৭.৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জন এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি-১৩.৩)-এর লক্ষ্যমাত্রা ‘জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত প্রভাব প্রশমন, অভিযোজন, প্রভাব কমানো এবং আগাম সতর্কবার্তা সম্পর্কিত শিক্ষা ও সচেতনতা এবং মানুষের ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার উন্নতি সাধন করা’Ñএটি বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের। তবে সহযোগী মন্ত্রণালয় হিসেবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও অধিদপ্তর বিশেষ করে তথ্য অধিদপ্তর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন জলবায়ু-সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানারকম প্রচার কার্যক্রম নিয়মিতভাবে করে থাকে।
২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার ৮.৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২১ থেকে ২০৪১ পর্যন্ত গড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন


 বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। উন্নয়নের এই দীর্ঘমেয়াদি উচ্চাশা অর্জন করতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রাকৃতিক ও জলবায়ু গুরুত্বের সঙ্গে এবং সতর্কতার সঙ্গে এর পরিবর্তনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নজরে রাখতে হবে। যে বিষয়গুলো অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে সেগুলো বিবেচনায় এনে ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় ভালো। আমাদের দেশের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন, পরিবেশবান্ধব উপায়ে প্রবৃদ্ধি অর্জন স্বল্পমেয়াদে ব্যয়বহুল এবং অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা টেকসই ও সাশ্রয়ী। পরিবেশের ওপর বেশি চাপ দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য ব্যাপক উন্নয়ন করা গেলেও এটা করতে গিয়ে ভূমির মান অবনমন, নদী ভাঙন, বন্যা, খরা, বায়ুদূষণ ইত্যাদির ফলে দীর্ঘমেয়াদি যে ক্ষতি হয়, তা থেকে পরিবেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। এটা ব্যয় সাশ্রয়ী হয় না।
২০১৫ সালের সরকারি এক হিসেবে দেখা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচটি প্রধান প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে দেশের মোট জিডিপির ১৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। আর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের যৌথ এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১০ সালে জলবায়ু-সংক্রান্ত দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর মানুষের জীবিকা, অবকাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থার ক্ষতি হয় দেশের মোট জিডিপির দশমিক ৫ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় কোনো পদক্ষেপ না নিলে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে মর্মে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০তে পরিমিত মাত্রায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে দেশের ১.৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মর্মে ধারণা দেয়া হয়েছে। ওই পরিকল্পনায় আরও দেখানো হয়েছে যদি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় তাহলে কি পরিমাণ ক্ষতি হবে এবং পরিকল্পিতভাবে পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। এতে দেখা গেছে, ২০৪১ অর্থবছর পর্যন্ত এ ক্ষতির ব্যবধান হবে প্রায় ২৭ শতাংশ। জলবায়ু পরিবর্তন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশগত ঝুঁকি সৃষ্টি হয় এবং তা জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানিবাহিত রোগসহ নানা ধরনের রোগ জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া বন্যা, খরা, নদী ভাঙন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, মানুষ উদবাস্তু হয়ে যায়। এসব বাস্তুচ্যুত মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যাপক মাত্রায় শহরে চলে আসে। ফলে শহরের জীবনযাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেয়। জীবন যাত্রারমান নি¤œগামী হয়। বিশেষ করে সেবা খাতে ব্যাপক আকারে এর প্রভাব পড়ে। বর্ধিত জনসংখ্যার চাপে পরিবহন সংকট, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, শিক্ষাব্যবস্থাসহ সব ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
অতিসম্প্রতি আমেরিকার ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত ২০২০ সালের ‘এনভায়রনমেন্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২ তম। এছাড়া ২০২০ সালের জলবায়ু ঝুঁকি সূচকেও দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ফলে ২০৪১-এ দারিদ্র্য শূন্য এবং উচ্চ আয়ের দেশ গড়তে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ নীতিতে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ও পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য পরিকল্পনা রয়েছে; যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্যাপক পর্যালোচনা পদ্ধতির মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা, ২১০০’ প্রণীত হয়েছে। পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করার আগে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ২৬টি ভিত্তিমূলক গবেষণা করা হয়েছে। এসব গবেষণার মধ্যে রয়েছেÑজলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র, পূর্ব অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা, পরিবেশ-সংক্রান্ত গভর্ন্যান্স এবং জ্ঞান ও উপাত্ত ব্যবস্থাপনা। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন, টেকসই উন্নয়ন অর্জনের উপায়গুলো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা অনেক সচেতন। এখন সবাই বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছেন। পরিবেশগত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সরকার ‘সেবা গ্রহীতার কাছ থেকে মূল্য আদায়’ ও ‘দূষণকারীর কাছ থেকে মাশুল আদায়’ নীতি বাস্তবায়ন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। টেকসই উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে বিশাল কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করতে হবে; এ জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। এ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় যুক্ত রয়েছে।
কভিড-১৯-এর আবির্ভাব দেশের চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতিপথ কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। কভিড-১৯-এর কারণে কখনও জীবন ও জীবিকার তাগিদে সব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে, আবার কখনও সীমিত আকারে চালু রাখতে হয়েছে। কাক্সিক্ষত উন্নয়ন কার্যক্রম পুরোদমে এগিয়ে নেয়া সব সময় সম্ভব হয়নি। তারপর ও উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ কভিড-১৯কে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে দেশে উন্নয়ন কার্যক্রমে এগিয়ে নিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী ও দক্ষ নেতৃত্বের কল্যাণে সব বাধা অতিক্রম করে ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের সঠিক পথেই চলছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
(getButton)


Post a Comment

0 Comments