মিয়ানমার এর রাজনৈতিক ইতিহাস

মিয়ানমার এর রাজনৈতিক ইতিহাস 

মিয়ানমার, যা আগে বার্মা নামে পরিচিত ছিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এর রাজনৈতিক ইতিহাস জটিল এবং অস্থিরতায় পরিপূর্ণ। দেশটি প্রাচীন রাজ্য, ঔপনিবেশিক শাসন, সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে।

      প্রাচীন এবং ঔপনিবেশিক যুগ                                                                        

মিয়ানমারের প্রাচীন ইতিহাসে পাইগু (Pyu) এবং মন (Mon) জনগোষ্ঠীর শাসন দেখা যায়। ১১শ শতাব্দীতে পাগান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, যা বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটায়। পরে এটি মঙ্গোল আক্রমণে পতিত হয়।

১৮২৪ থেকে ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধে ব্রিটিশরা বার্মাকে দখল করে এবং এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ হয়। ১৯৩৭ সালে বার্মাকে পৃথক প্রশাসনিক ইউনিট করা হয়। ব্রিটিশ শাসনের সময় মিয়ানমারে আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন ঘটলেও জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, বার্মিজ জাতীয়তাবাদী নেতারা জাপানের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। কিন্তু জাপানের শাসন অত্যাচারী হয়ে উঠলে, তাঁরা আবার ব্রিটিশদের সহযোগিতা করেন। যুদ্ধ শেষে, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বার্মা স্বাধীনতা অর্জন করে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক সংকট

স্বাধীনতার পরেই দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতায় পড়ে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্রোহ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এরপর সামরিক সরকার সমাজতন্ত্রের নামে কঠোর শাসন চালায়, যা দেশের অর্থনীতি ও জনগণের জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

সামরিক শাসন এবং গণতন্ত্রের আন্দোলন

১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন শুরু হয়, যা ৮৮৮৮ অভ্যুত্থান নামে পরিচিত। সামরিক সরকার এটি নির্মমভাবে দমন করে। এই সময়ই অং সান সু চি জাতীয় নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জয়লাভ করে, কিন্তু সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা

২০১০ সালে মিয়ানমারে আংশিক গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং অং সান সু চি গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পান। ২০১৫ সালে এনএলডি পুনরায় জয়লাভ করে এবং সু চি কার্যত দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তবে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। এই অভ্যুত্থান দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন ঃ 

অং সান সু চি: বন্দিত্বের কারণ এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রের সংগ্রাম

রোহিঙ্গা সংকট

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন। রাখাইন রাজ্যে সামরিক অভিযান, যা জাতিগত নিধন হিসেবে বর্ণনা করা হয়, লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

উপসংহার

মিয়ানমারের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বাধীনতা, সামরিক শাসন, এবং গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক অভ্যুত্থান এবং রোহিঙ্গা সংকট দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে মিয়ানমারের জনগণ গণতন্ত্রের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

Post a Comment

0 Comments